ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারায়ণগঞ্জের এই নিদর্শন সংস্কার করে রক্ষণাবেক্ষণের দাবি

অযত্ন-অবহেলায় সোনাকান্দা দুর্গ

​​​​​​​মো. খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০:৪২, ২৪ মার্চ ২০২৩

অযত্ন-অবহেলায় সোনাকান্দা দুর্গ

নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন সোনাকান্দা দুর্গ

নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন সোনাকান্দা দুর্গ। এটি শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে বন্দরের সোনাকান্দা এলাকায় অবস্থিত। দুর্গটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় পড়েছে। ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা দুর্গটি দেখতে ছুটে আসছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঐতিহাসিক নিদর্শন দুর্গটি আজ বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। অযত্ন-অবহেলায় দিন দিন দুর্গটির সৌন্দর্য হারাচ্ছে। দুর্গের ইট, সুরকি খসে খসে পড়ছে। দেখভাল করার কেউ নেই। প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনের অমূল্য এই সম্পদ এভাবে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভে সৃষ্টি হয়েছে। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সোনাকান্দা দুর্গ মুঘল আমলে নির্মিত একটি জল দুর্গ। এটি ১৬৫০ সালের দিকে তৎকালীন বাংলার সুবাদার মীর জুমলা কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সপ্তদশ শতকে ঢাকা শহরকে বহির্শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে যে তিনটি জল দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল সোনাকান্দা দুর্গ তারমধ্যে অন্যতম। ১৫৫৭ সালে মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের নিকট দাউদ খান কিররানির পরাজয়ের মধ্যদিয়ে বাংলা মুঘল সা¤্রাজ্যের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আসে।

মুঘলরা বাংলায় একটি প্রগতিশীল শাসন ব্যবস্থা স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাকে বহির্শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে দৃঢ় নীতি গ্রহণ করেন। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর জুমলাকে তৎকালীন বাংলা প্রদেশের সুবাদার বা গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি জলদস্যু দ্বারা বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে লুটতরাজ চালানোর ব্যাপারে অবগত ছিলেন। জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রাজধানী ঢাকাকে রক্ষা করতে তিনি ঢাকার আশেপাশে তিনটি জল দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা দুর্গ তারমধ্যে একটি। এই দুর্গ নির্মাণের তারিখ সংবলিত কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে ঐতিহাসিকদের মতে এটি ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল।

দুর্গটিতে রয়েছে ইস্টক নির্মিত পুরু দেয়াল। একটি বিশাল কামান প্ল্যাটফর্ম এবং উত্তরমুখী একটি প্রবেশ তোরণ। দুর্গটিতে মূলত দুটি প্রধান অংশ লক্ষ্য করা যায় একটি হচ্ছে-আত্মরক্ষামূলক প্রাচীরের বিশাল আয়তন যা .০৫ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন এবং যার মধ্যে গোলা নিক্ষেপের জন্য বহুসংখ্যক প্রশস্ত-অপ্রশস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। যা থেকে বন্দুক এবং হালকা কামান ব্যবহার করে জলদস্যুদের দিকে শেল নিক্ষেপ করা যেত।

অপরটি হচ্ছে পশ্চিমদিকের উঁচু মঞ্চ যা দুর্গকে জলদস্যুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হচ্ছে দুর্গের বিশাল কামান প্ল্যাটফর্ম। গোলাকার কামান প্ল্যাটফর্মের একটি সিঁড়ি রয়েছে। কামান প্ল্যাটফর্মের উঁচু মঞ্চে শক্তিশালী কামান নদীপথে আক্রমণকারীদের দিকে তাক করা থাকত।

এটি মুঘলদের জলদুর্গের একটি অনন্য  বৈশিষ্ট্য। চতুর্ভুজাকৃতির দুর্গটির আয়তন ৮৬.৫৬ মি. থেকে ৫৭. মি. এখানে অষ্টভুজাকৃতির চারটি বুরুজ দুর্গের চার কোণে রয়েছে। দুর্গের একমাত্র প্রবেশ তোরণটি উত্তর দিকে। প্রবেশদ্বারটি একটি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে।

জল দুর্গকে ঘিরে নানারকম কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। যেমন-বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের কন্যা স্বর্ণময় শীতলক্ষ্যা নদীতে  স্না করতে গিয়ে জলদস্যু দ্বারা অপহৃত হন। সোনারগাঁর শাসক ঈশা খাঁ তাকে উদ্ধার করে দুর্গে নিয়ে আসেন তার পিতাকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কেদার রায় তাকে মুসলমানের ঘরে রাত কাটানোর দায়ে ফিরিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মর্মাহত রাজকুমারী স্বর্ণময়ী দুর্গে বসে কেঁদেছিলেন বলে এই দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা।

বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম নেতা ঈশাখাঁ বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের বিধবা কন্যা সোনা বিবিকে জোড়পূর্বক বিয়ে করে এনে এই দুর্গে বন্দি করে রেখেছিলেন। কিছু মানুষ বিশ্বাস করত যে দুর্গের ভেতরের গুপ্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে সোনারগাঁও এবং ঢাকার লালবাগ কেল্লার সঙ্গে সংযোগ ছিল।

সোনাকান্দা দুর্গে সরেজমিন গেলে স্থানীয় লোকজন দুর্গটি অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সময় দুর্গের অভ্যন্তরে কয়েকজন শিক্ষার্থী অবস্থান করতে দেখা গেছে। সময় দুর্গের অভ্যন্তরে -১০টি ছাগল চড়াতে দেখা গেছে।

সোনাকান্দা চৌধুরীপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিক্ষার্থী তানভির আহমেদ নিরব বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে ঐতিহাসিক দুর্গটি কোনো সংস্কার কাজ হয়নি। দুর্গের অভ্যন্তরে প্রতিদিন আমরা ক্রিকেট ফুটবল খেলছি। দুর্গটি আজ অযত্নে-অবহেলায় পড়েছে। দিন দিন দুর্গের ইট, সুরকি খসে খসে পড়ছে। এখনো দুর্গটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী ছুটে আসছেন।

কেল্লা জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন মো. আতাউল্লাহ বলেন, দুর্গের ভেতরে সন্ধ্যা পর গাঁজার আসরসহ নানা অপকর্ম হয়। এমনকি দিনের বেলায় মাদকসেবীরা দুর্গের অভ্যন্তরে বসে গাঁজা খাচ্ছে। দুর্গটি রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।

সোনাকান্দা দুর্গের সাইট পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, বেশ কয়েকমাস আগে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্গটি পরিদর্শন করেছে গেছেন। শুনেছি দুর্গটি সংস্কার করা হবে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শাহিন মিয়া বলেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে দুর্গটি নিয়ে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা আছে কিনা তা এখন বলতে পারছি না। মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করে পরে জানাতে পারব।

×