
নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা
এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে...। নীর্মল নীল সেই পথটি ধরে আবারও এসেছে শরত। গত মঙ্গলবার প্রিয় ঋতুর আগমন ঘটে বাংলায়। আজ বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিন। এরই মাঝে রূপ বদলাতে শুরু করেছে প্রকৃতি।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে তৃতীয় ঋতুটি শরত। এর বিস্তৃতি ভাদ্র থেকে আশ্বিন পর্যন্ত। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে শরত ঘিরে বাঙালীর রয়েছে বাড়তি কৌতূহল। অনেকেই আকাশের পানে ঘন ঘন তাকাচ্ছেন। নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াওড়ি দেখছেন মুগ্ধ চোখে। অবশ্য ঢাকার আকাশ অনেক আগেই চুরি হয়ে গেছে। ওপরের দিকে তাকালে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কংক্রিটের বহুতল ভবন কিংবা উড়াল সেতু।
এর পরও ফাঁকফোকর দিয়ে রাজধানীবাসী শরতের নীল আকাশ দেখার চেষ্টা করছেন। আরও একটু ভাল করে দেখতে চান যারা তাদের বলি, প্রেসক্লাব এলাকায় রাস্তার ধারে বেশ কটা নারিকেল গাছ। মাথা উঁচু করে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্য নারিকেল বিথীর ওপরে যেন হেলে পড়ছে আকাশ। নীল আকাশে সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকিয়ে দেখলে নাগরিক ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়। মন গুণগুণ করে গাইতে শুরু করে- ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা-/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা।’
শরতের আরেক সৌন্দর্য কাশফুল। এ সময় নদীর ধারে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ফুটে থাকে সাদা কাশফুল। গ্রামের অপরূপ ছবি এখন ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। কবিগুরুর বলাটি এ রকম- ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা- নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।’
কাশের মতো শিউলিও শরতের আরেক দান। সেরা দানও বলা যায়। কারণ প্রিয় ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ শরতকে ছড়িয়ে দেয়। দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল কোন এক সকালের বর্ণনা দিয়ে লিখেছিলেন, শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/শেফালি ফুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...।
শরতে শুধু প্রকৃতি নয়, মনও বদলাতে থাকে। পরিবর্তিত হয়। শরতের আনন্দ প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।/আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে...।
নজরুল শরতে হারানো প্রিয়ার শোক করেছেন। লিখেছেন- শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই...। একই রকম বিরহ আক্রান্ত হয়ে কবি লিখেছেন- দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। প্রায় অভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে কবিগুরু লিখেছেন- আজি শরতাপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরাণ কী যে চায়।/ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো...।
সব মিলিয়ে শরত অনন্য। প্রতি বছর নানা আয়োজনে এ ঋতুকে বরণ করে নেয় বাঙালী। রাজধানী শহরে একাধিক উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবারও হবে বলে জানা গেছে। উৎসবের অন্যতম আয়োজক মানজার চৌধুরী সুইট বলছেন, আমরা যথারীতি শরত উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সঙ্গীত নৃত্য কবিতার ভাষায় শরত বন্দনা করা হবে।
অবশ্য শরতের সবই যে উপভোগ্য, না, সে কথা বলা যাবে না। এই যেমন, নতুন ঋতুর আগমনে গরমটা আরও বেড়ে গেছে। ভ্যাপসা গরম। সামনে হয়ত আরও বাড়বে। তবে ছোটখাটো ভোগান্তি বাদ দিলে শরত অপরূপ। অনন্য।