
বগুড়া নগরীতে বায়োস্কোপওয়ালা
বগুড়া নগরীতে বায়োস্কোপের বাক্সে ‘কি চমৎকার দেখা গেলো’। এ্যাডওয়ার্ড পার্কে এসেছিলেন বায়োস্কোপওয়ালা। এখন তারা শহরমুখী হচ্ছেন। চৌকোনা কাঠের বাক্সের তিন দিকে গোলাকৃতির ৬/৭ টি উচ্চ ক্ষমতার আতস কাঁচ। ছেলে বুড়ো তরুণ-তরুণী ওই আতস কাঁচে (ম্যাগনিফাই গ্লাস) চোখ লাগিয়ে পর্দায় স্থির চিত্র দেখে। এই ছবি নানা ধরনের। ইতিহাসের ছবি। রাজা- বাদশাহর ছবি। কল্প কাহিনীর ছবি। বিশে^র বড় বড় নগরীর ছবি। চিত্রতারকাদের ছবি। দেশের নদী বিল খেত খামার। কত ধরনের ছবি যে আছে। হালে এই বায়োস্কোপ আধুনিকায়ন হয়েছে। বিশেষ পদ্ধতিতে স্থির থেকে চলমান করা হয়েছে। মনে হবে ছবিগুলো ধারাবাহিকভাবে পুতুল নাচের মতো নাচছে।
বায়োস্কোপের ইতিহাস বলে ১৮শ’ শতকের মধ্যভাগে এই বায়োস্কোপ ছিল শহর বা নগর কেন্দ্রিক। তখন সিনেমা হল ব্যাপক আকারে হয়নি। সিনেমাটোগ্রাফ (মুভি ক্যামেরা) সেভাবে ছিল না। ইংরেজ শাসনামলে বেনিয়ারা এই বায়োস্কোপের বাক্সে ছবি দেখে বিনোদন পেত। ইংরেজদের ছবি ব্রিটিশদের নানা কর্মকা-ের ছবি বায়োস্কোপের বাক্সে প্রদর্শিত হতো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় স্টিফেন্স নামের একজন ব্রিটিশ ১৮৬৯ সালে থিয়েটার সঙ্গে নিয়ে কলকাতা যান। সেখানে বায়োস্কোপের বাক্সে স্থিরচিত্রের মাধ্যমে ধারা বর্ণনায় থিয়েটার উপস্থাপন করেন।
তার উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হিরালাল সেন ১৮৭৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে শহর ও নগরীর বিভিন্ন স্থানে বায়োস্কোপ প্রদর্শন শুরু করেন। দিনে দিনে এই বায়োস্কোপ শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। নগরীর বনেদী পরিবার বায়োস্কোপওয়ালাদের বাড়িতে ডেকে এনে প্রদর্শন করেন। বনেদী পরিবারের কল্যাণে আশপাশের লোকজন বাড়ির সামনে আঙিনায় উন্মুক্ত স্থানে বায়োস্কোপ দেখে। শহরাঞ্চলে এর প্রভাব ছিল বেশি। দিনে দিনে এর পরিচিতি পায় কাঠের বাক্সের সিনেমা হল। কেউ বলে বায়োস্কোপের বাক্স।
আধুনিক ঢাকার প্রতিষ্ঠালগ্নে নওয়াবদের বাড়িতে নিয়মিত বায়োস্কোপের সিনেমার আসর বসতো। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল এক শ্রেণীর মানুষের জীবন-জীবিকা। তাদের পরিচয় ছিল বায়োস্কোপওয়ালা।
তারা বিভিন্ন স্থান,বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে নানা ধরনের ছবি সংগ্রহ করত। কখনও কোন শিল্পীর কাছে থেকে ছবি আঁকিয়ে নিত। তারপর ঘূর্ণন কাঠিতে পেঁচিয়ে সাজাতো। বাক্সের ওপরে থাকত ঘূর্ণন কাঠির হাতল। হাতল ঘুরিয়ে জোড়া লাগানো ছবি একটা একটা করে পার করা হতো। বাক্সের ভেতরে ছবি ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার হতো টর্চের আলো। সুরের কথার সঙ্গে বাজাত খঞ্জনা। বাজতে থাকা খঞ্জনি ও ছন্দময় বাক্য দর্শকদের আকৃষ্ট করে মোহবিষ্ট করে তুলত। বায়োস্কোপওয়ালা ছবি প্রদর্শনের সময় ছন্দের কথায় বর্ণনা করত। যে কথাগুলো ছিল শ্রুতিমধুর। যেমন ‘কি চমেৎকার দেখা গেলো-এইবারেতে আইস্যা গেল সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধ করলো। কি চমেৎকার দেখা গেল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল বানাইলো। এইবারেতে দেখা গেল লখিন্দর ভাইসা গেল। বেহুলা ভেলায় চড়ল। এইবারেতে দেখা গেল ঢাকার ঠাঁটারি বাজারের হাপরগুলা। কি চমেৎকার দেখা গেল ঢাকার এক্কাগাড়ি ছুটে গেল। এইবারেতে দেখা গেল রেসকোর্সের ঘোড়া ছুটলো।’ কথার চমকে এইভাবে কত যে বর্ণনা করত বায়োস্কোপওয়ালারা। কিছু কথা শুনলে হাসি থামানো যেত না।
যেমন এইবারেতে দেখা গেল লাইলী মজনু পীরিত করল। লাইলীর পিঠে লাঠি পড়ল। মজনু মিয়া দুঃখু পায়া উহু করলো। বংশ পরম্পরায় এই বায়োস্কোপওয়ালারা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের (বিংশ শতক) ত্রিশের দশকের শেষে সিনেমা হলে নির্বাক চলচ্চিত্র শুরু হলে সেই ছবির গল্প নিয়েও বায়োস্কোপওয়ালার বর্ণনায় ছবি সাজাত। যেমন দেবদাসের গল্প নিয়ে স্থির ছবি সাজাত। আরও পরে সবাক সিনেমা শুরু হলে বায়োস্কোপওয়ালারা কিছুটা বিপাকে পড়ে। এরা তখন শহরের এদিক সেদিক ঘুরতে থাকে।
তারপর গ্রামমুখী হয়। তখন সিনেমার রমরমা অবস্থা। দীর্ঘ সময় গ্রামগঞ্জের পথ পাড়ি দিয়ে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় শতকে তারা শহরমুখী হয় নতুন আয়োজনে।
প্রতিটি শহরে কোন না কোন সময়ে নানা ধরনের মেলা বসে। এই মেলায় বিনোদনের ডালা নিয়ে বসেছেন কাঠের বাক্সের আতস কাঁচের বায়োস্কোপওয়ালা। বগুড়ায় একটি মেলায় এসেছিলেন আব্দুল লতিফ। জানালেন তার পূর্বপুরুষ বায়োস্কোপ দেখাত। বর্তমানে প্রতি পনেরো মিনিট বায়োস্কোপ দেখানোর জন্য জনপ্রতি পাঁচ টাকা করে নেন। সাতটি আতস কাঁচে সাত জন দেখতে পায়। দিনভর অন্তত দশটি শো পরিচালনা করেন। লোকজন এই বায়োস্কোপ দেখে মজাও পায়। বায়োস্কোপের বাক্সে নতুন নতুন ছবি সংযুক্ত করেছেন। বর্তমানে ছবি পাওয়া কঠিন নয়। বিভিন্ন মাধ্যমে ছবি সংগ্রহ করেন।
সত্তরের দশকে টেলিভিশনকে অনেক বলতো বায়োস্কোপের বাক্স। এই সময়ে টেলিভিশন কেবল শহরকেন্দ্রিক হয়ে যাত্রা শুরু করেছে। বায়োস্কোপ কথাটির শুরু শহরে। পরবর্তী সময়ে যার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। দীর্ঘ সময় বায়োস্কোপওয়ালারা ঘরবন্দী থেকে ফের শহরমুখী হয়েছেন। বগুড়ার বায়োস্কোপওয়ালা এই বাক্স পেয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে। যা এখন তার জীবিকার অন্যতম উৎস।