
ভালবাসা শব্দটির ব্যাপ্তি বা পরিধি অনেক বড় বা বিশাল। ভালবাসা মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভালবাসা বলতে বোধ বা অনুভূতিকে বোঝায়। এটা অনুভব করার ব্যাপার, বোঝার ব্যাপার। কেউ কাউকে ভালবাসলে সেটা মুখে বলা না হলেও আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, ইশারা-ইঙ্গিত ইত্যাদির মাধ্যমেও বোঝানো যায় বা অনুভব করা যায়। কিছু ভালবাসা প্রকৃতি প্রদত্ত, আত্মিক বা রক্ত সম্পর্কিত। মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোনের ভালবাসা নির্মল। এই ভালবাসা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জন্মায়। অন্য সব ভালবাসা যেমন স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদি ভালবাসার সম্পর্ক গড়তে হয়, লালন করতে হয়। ভালবাসাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। একেক সম্পর্কের ভালবাসা একেকরকমের হয়ে থাকে। যার হৃদয়ে ভালবাসা নেই তাকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গণ্য করা যায় না। তবে ভালবাসা প্রায় সকলের হৃদয়েই কম-বেশি থাকে। ভালবাসা ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। কিছু ক্ষেত্রে ভালবাসাকে মেকি ভালবাসা বলা যায়, যা শুধু মানুষকে খুশি করার জন্য প্রকাশ করা হয়, অন্তর থেকে নয়। কথায় আছে ভালবাসা দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। ভালবাসা ধর্ম, বর্ণ, সমাজ, ছোট-বড়, উঁচু-নিচু জাত-পাত কিছুই মানে না। ভালবাসা মহীয়ান। ভালবাসা অম্লান। সত্যিকারের ভালবাসা কৃত্রিমতাবিবর্জিত।
পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে অনেক দিন যাবত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে ভালবাসা দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান প্রথম বাংলাদেশে ভালবাসা দিবস পালনের প্রচলন শুরু“করেন। ভালবাসা দিবসে তিনি প্রথম গোলাপ ফুল উপহার দিয়ে দিবসের প্রচলন শুরু“করেন। আমরা এখন নানাভাবে এই দিবসটি পালন করি। ফুল, বিশেষ করে লাল গোলাপ উপহার হিসেবে ভালবাসার মানুষকে দেয়ার রীতি প্রচলিত আছে। অনেকে আবার ভালবাসার রং লাল বিধায় ভালবাসা দিবসে লাল পোশাক পরিধান করে। ভালবাসা অনাবিল। আমাদের দেশে বর্তমানে বেশ আয়োজনের সঙ্গে শহর এলাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীরা ভালবাসা দিবস পালন করে থাকে ব্যক্তিগতভাবে। সরকারীভাবে এ দিবস পালনের জন্য কোন আয়োজন করা হয় না। ভালবাসা একদিনের জন্য নয়, প্রতিদিনই ভালবাসা দিবস। ভালবাসা চলমান প্রক্রিয়া। ভালবাসা নিরন্তর, ভালবাসা অনন্ত।
ভালবাসা দিবসের শুরু“কিভাবে সে সম্পর্কে নানা গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে তিনটি গল্পকে ভালবাসা দিবসের শুরু“বা উৎপত্তি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। প্রথম গল্পটি প্রচলিত আছে এভাবে যে, ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন শিশুপ্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপি মানুষ। তিনি খ্রীস্টান ধর্মের অনুসারী এবং রোম সাম্রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোডিয়াস দেব-দেবীর পূজারী ছিলেন। সম্রাট তখন ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দেব-দেবীর পূজা করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করেন। এর ফলে সম্রাট ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মযাজককে বন্দী করেন এবং পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই ভালবাসার প্রেমিক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই দিবস।
দ্বিতীয় গল্পটি প্রচলিত আছে এরকম যে, কারারুদ্ধ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই দেখতে আসতেন, সঙ্গে আনতেন ফুল। কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলতে আসতেন। এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যান। ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসার মাধ্যমে মেয়েটি এক সময় তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। তরুণ-তরুণীদের প্রতি ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের ভালবাসা এবং ভ্যালেন্টাইনের প্রতি তরুণ-তরুণীদের ভালবাসার কথা জানতে পেরে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং সেই সময় অর্থাৎ ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
তৃতীয় গল্পটি ছিল এমনÑ রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোডিয়াসকে তার সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে দরকার ছিল বিশাল এক সেনাবাহিনীর। এজন্য সেনাবাহিনীতে যুবকদের যোগদানে বাধ্য করতে বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তৎকালীন সম্রাট ক্লোডিয়াস। তার এ ধরনের ঘোষণায় সে দেশের যুবক-যুবতীরা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনও এ নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। তিনি গোপনে তার গীর্জায় বিয়ে পড়ানোর কাজ পালন করতে থাকেন। তখন তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালবাসার বন্ধু’ বা ঋৎরবহফ ড়ভ খড়াবৎং নামে। যখন ভ্যালেন্টাইনকে দেয়া এই উপাধিটি সম্রাট ক্লডিয়াসের কানে গেল তখন তিনি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারি সৈন্যরা ভ্যালেন্টাইনকে হাত-পা বেঁধে সম্রাটের কাছে নিয়ে হাজির করেন। তখন সম্রাট তাকে হত্যার আদেশ দেন। এরকম নানা গল্প প্রচলিত আছে ভালবাসা দিবস উদ্যাপনের পেছনে।
মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা চিরন্তন। ফলে এই ভালবাসা থেকেই ভালবাসা দিবসের উৎপত্তি। ভালবাসা মানুষের হৃদয়ে, অন্তরে, চিত্তে, মননে বিরাজ করে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে ভালবাসার জন্ম হয়। এই ভালবাসা সর্বজনীন। ভালবাসা সব মানুষের মধ্যে বিরাজ করে কম-বেশি। এর বহির্প্রকাশ একেক জনের ক্ষেত্রে একেকরকম। ভালবাসা নির্ভর করে মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতির ওপর। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতির মিল না হলে সেখানে ভালবাসার সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয় না। সম্পর্ককে সঠিকভাবে লালন করার ওপর ভালবাসার স্থায়িত্ব নিহিত। ভালবাসার সম্পর্ককে সম্মান করতে হবে। যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্মানবোধ প্রয়োজন। সম্পর্ককে সম্মান দিতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে। সে যে সম্পর্কের ভালবাসাই হোক না কেন। ভালবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ অনেকাংশে ভূমিকা রাখে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সম্পর্কে জড়িত সকলকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে হয়।
ভালবাসার পরিধি বৃহত্তর। এই বৃহত্তর ভালবাসার পরিধিতে দেশকে ভালবাসাও এক ধরনের ভালবাসা। দেশকে ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে নিজ নিজ পরিসর থেকে পালন করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের কাছে তার দেশ মাতৃসম। দেশ মাতাকে ভালবাসা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। যে দেশের জনগণের মধ্যে তাদের দেশের প্রতি ভালবাসা, দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ যত বেশি সে দেশ তত উন্নত। দেশের প্রতি ভালবাসা বা দেশপ্রেম না থাকলে সে দেশ উন্নত হতে পারে না। দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা। দেশের প্রতি ভালবাসা, দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু“করে রাজনীতিবিদ ও অন্য সকলের মধ্যেই থাকতে হবে। এছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশকে ভালবাসতে হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে এ ভালবাসা দিবসে মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ভালবাসার পাশাপাশি দেশকেও ভালবাসার প্রতিজ্ঞা করি। ভালবাসা বিরাজ করুক সবার অন্তরে, হৃদয়ে, সকল ক্ষেত্রে, সর্বস্তরে।
লেখক : সদস্য (অর্থ) নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ