ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

দুর্গার রূপের আরাধনা

প্রকাশিত: ২১:০৫, ১৩ অক্টোবর ২০২১

দুর্গার রূপের আরাধনা

শরতকালে মৃন্ময়ী দুর্গামূর্তির পূজা যে কত প্রাচীন তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। মার্কে-েয় পুরাণে (৯৩ অধ্যায়) বলা হয়েছে, সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য মেধস ঋষির নিকট দেবীমাহাত্ম্য শুনে নদীতীরে গিয়ে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি গঠন করে পূজা শুরু করেন এবং নিজ নিজ দেহের রক্তযুক্ত বলি প্রদান করেন। এভাবে পর পর তিন বছর পূজা পেয়ে দেবী চ-িকা রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের কাছে আবির্ভূত হয়ে তাদের কাক্সিক্ষত বর দান করেন। সুরথ রাজা ও সমাধি বৈশ্য তিন বছর ধরে দুর্গাপূজা করে এই মর্ত্যলোকে মায়ের পূজার প্রচলন করেন। আশ্বিন মাসে তিন দিনব্যাপী দুর্গাপূজার বিধি পাওয়া যায় কালিকা পুরাণে (৬০/২৬)। তবে ভগবান রামকে অনুগ্রহ করার জন্য এবং রাবণকে বধ করার জন্য রাত্রিকালে (অকালে বা দেবতাদের নিদ্রা যাওয়ার সময়ে) দুর্গাদেবীকে ব্রহ্মা বোধিত বা জাগরিত করেছেন। এ বিষয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বাল্মীকীর রামায়ণের সঙ্গে কালিকা পুরাণের মতভেদ রয়েছে। কালিকা পুরাণে (৬০/৭৯-৮২) বর্ণনা করা হয়েছে, দুর্গাপূজা যে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধরত রণদেবী জগন্মাতারই পূজা। ‘যখন মহাদেবী স্তুত এবং বোধিত হয়েছেন তখন আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী দিনে জগন্ময়ী প্রাদুর্ভূত হয়েছেন। সুশোভন শুক্লপক্ষের সপ্তমী দিনে সেই দেবী দেবগণের তেজোময়ী মূর্তি ধারণ করেছেন। অষ্টমী দিনে দেবতারা তাকে অলঙ্কার পরিয়েছিলেন। নবমী দিনে নানা উপহারে দেবী পুজিতা হয়েছেন এবং দশমী দিনে মহিষাসুর বধের পর দেবতাগণ তাঁকে পরিত্যাগ করলে তিনি অন্তর্হিতা হয়েছিলেন।’ মহাভারতের ভীষ্মপর্বে (২৩/২) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সখা অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘শত্রুকে পরাজিত করার জন্য দুর্গাস্তোত্র পাঠ কর’। অর্জুন দুর্গার স্তব করলেন। দেবীদুর্গা খুশি হয়ে তাকে বর দান করলেন, ‘তুমি শীঘ্রই শত্রু জয় করবে।’ মহিষাসুর বধিনী দেবী যুদ্ধে জয়-পরাজয় বিধায়িনী রণদেবী হলেন এবং নদ, নদী, পর্বত, বন ও পর্বতগুহার অধিষ্ঠাত্রী দেবীগণের সঙ্গে মিলে জগত মাতার জগত মূর্তি ধারণ করলেন। দেবীর এই জগত মূর্তিতে সভ্য-অসভ্য সব জাতির দেবীগণ মিলিত হলো। হরিবংশের আর্য্যা স্তবে (৫৯/৩২৭৩-৩২৮৪) আছেÑ ‘হে মহাদেবী। শবর, বর্বর, পুলিন্দগণের দ্বারা পুজিতা হয়ে তুমি দুর্গম পর্বতের শিরোদেশে, নদীতে, গুহাতে, বনে, উপবনে বাস কর।’ সংস্কৃত সাহিত্যে (বাসবদত্তা, হর্ষচরিত, কথাসরিৎসার প্রভৃতি গ্রন্থে) বিন্ধ্যাপর্বতবাসী অসভ্য জাতিদের শবর, পুলিন্দ, কিরাত নাম দেয়া হয়েছে। দুর্গার সঙ্গে শবরাদি পুজিতা বনদেবীগণ মিলিত হওয়ায় দুর্গাদেবীর পূজাপদ্ধতিতেই শবরাদির আচার মিশেছে। এ কারণে শাস্ত্রকারগণ দুর্গাপূজা সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক; এই তিন প্রকারে ভাগ করেছেন। শারদীয় চ-িকা পূজা তিন প্রকার। যথা-সাত্ত্বিকী, রাজসী ও তামসী। নিরামিষ নৈবেদ্য দিয়ে এবং জপ ও যজ্ঞানুষ্ঠান করে সাত্ত্বিকী পূজা করা হয়। পুরাণাদিতে ভগবতীর যে মাহাত্ম্য বর্ণিত রয়েছে, তা পাঠ করাকে জপ বলে। দেবীকে মনস্থির করে ওই মাহাত্ম্য পাঠ করতে হবে। বলিদান করে এবং আমিষসহ নৈবেদ্য দিয়ে রাজসী পূজা করতে হয়। বিনা জপ, বিনা যজ্ঞ, বিনা মন্ত্র, মদ-মাংস প্রভৃতি উপহার দিয়ে তামসী পূজা করা হয়। তামসী পূজা কিরাত জাতি করে থাকে। সভ্যতার তিন স্তরের লোকেরা এই তিন প্রকার পূজা করতেন। সভ্য লোকেরা করতেন সাত্ত্বিকী পূজা, অর্ধসভ্যরা করতেন রাজসী পূজা এবং অসভ্যরা করতেন তামসী পূজা। রঘুনন্দনধৃত কালিকা পুরাণের বচনে সকলের জন্যই দশমী দিনে শাবরোৎসব করার বিধান রয়েছে। শবরোৎসব অবশ্যই শবরগণের আচার। দুর্গাদেবীর স্বরূপ কল্পনায় এবং দুর্গাপূজা পদ্ধতিতে নানা প্রকার উপাদানের মিশ্রণ দেখে অনুমেয় যে, দুর্গোৎসব অতি প্রাচীন অনুষ্ঠান। সম্ভবত তামসী পূজায় এই উৎসবের সূচনা এবং সাত্ত্বিকী পূজায় এর চরম পরিণতি। একদিকে শবরোৎসব আরেকদিকে দেবীমাহাত্ম্যের উন্নত ভাব। পাশাপাশি রেখে বিচার করলে এই দুর্গোৎসবে মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রায় আগাগোড়ার নিদর্শন একত্রে দেখতে পাওয়া যায়। দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা নামে পরিচিত হয়। এই মহাদেবীই শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদ্বয়কে বধ করেন। তিনিই আবার ভক্তিপরায়ণ তপোবন ঋষিগণকে শাকের দ্বারা অতিথি সৎকার করে শাকম্ভরী নাম ধারণ করেন। নৃতত্ত্ববিদ্গণের মতে, দেব-দেবীর কল্পনা ক্ষেত্রে শাক-প্রসবিনীর বা শাকভিমানিনী দেবতার কল্পনা অতি প্রাচীন বলেই দুর্গা শাকম্ভরী রূপে কল্পিত হয়েছিলেন। দুর্গোৎসবের সময়ও এরূপ অনুমান সমর্থন করে। দুর্গোৎসব একবার হয় বসন্তকালে, চৈতালি শস্য কাটার সময়ে। দুর্গোৎসবের প্রশস্তকাল শরত ঋতু, বাংলাদেশে ধান কাটার সূচনায়। যখন শস্য পাকে এবং কেটে আনার সময় হয়, সে সময় মানুষের মন শাকম্ভরীর প্রতি ভক্তিতে; অথবা শস্য ভাল না ফললে ভয়ে মন পূর্ণ হয়। সে সময়ই দেবীর পূজার উপযুক্ত সময়। দুর্গাপূজার সঙ্গে উদ্ভিদের সম্বন্ধসূচক আরও উপযুক্ত প্রমাণ রয়েছে ষষ্ঠী ও সপ্তমী তিথিতে। ষষ্ঠী তিথিতে সায়ংসন্ধ্যার সময় বেল গাছে দেবীর বোধন করা হয়। সপ্তমী তিথিতে পূর্বাহ্নে নব পত্রিকা (কলা, ডালিম, ধান, হলুদ, মান কচু, কচু, বেল, অশোক ও জয়ন্তী- এই নয় প্রকার গাছ) পূজার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং মহিষাসুর মর্দিনীর পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে শস্য উৎপাদনের এবং রক্ষার জন্য বসন্তে এবং শরতকালে শাকম্ভরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও আনন্দ-উৎসব। অকালবোধনজাত দেবী দুর্গা যে শক্তিতে, যে রূপেই তিনি অধিষ্ঠিতা হন না কেন, আপামর বাঙালী দশভুজাকে গ্রহণ করেছে অসুর নাশ করার শক্তির আধার রূপে। তিনি জগত জননী, তিনি মায়ার আঁধার মহামায়া। তিনিই আবার বাঙালীর ঘরের কন্যা। এ কারণেই বাঙালী দেবী দুর্গার রণ-রঙ্গিনী মূর্তিকে যেমন আপন করে নিয়েছেন; তেমনি শাড়ি পরা, সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পিতৃগৃহে আগত মেয়েরূপেও দুর্গাকে বরণ করে নিয়েছেন। সেই অসুর নাশিনী হিমালয় কন্যা দেবীদুর্গার রাতুল চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব সফল ও আনন্দময় হোক- এই প্রত্যাশা সবার। লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজ এবং প্রাক্তন সভাপতি, শ্রীচৈতন্য শিক্ষা ও সংস্কৃত সংঘ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×