বাংলাদেশে মাদকের বিস্তৃতি আজ ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। একটি দেশের বর্তমানের আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ধ্বংস করে ফেলে মাদক। মাদকের মরণ ছোবলে আক্রান্ত তরুণ ও যুব সমাজ আজ বিপর্যয়ের মুখে। মাদকাসক্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সব দেশের মধ্যে সপ্তম। ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে এখন মাদকসেবীর সংখ্যা ৭০ লাখ। বর্তমান সমাজে মাদক জন্ম দিচ্ছে একের পর এক অপরাধ। মাদকের ছোঁয়ায় সম্ভাবনাময় তারুণ্য শক্তি অধঃপতনের চরম শিখরে উপনীত হচ্ছে। মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি সারা বিশ্বের তারুণ্যের মধ্যে এক ভয়াবহ মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে। মাদক এখন সহজলভ্য। শহর-নগর, গ্রামসহ মফস্বল এলাকায়ও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিলের আবির্ভাব হয়। পর্যায়ক্রমে এটার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। নব্বইয়ের দশকে মাদকের জগতে সংযোজন হয় ইয়াবা। এ ছাড়া গাঁজা, আফিম, চরশ, বাংলা মদ, গুল, মরফিন, কোকেন, বিয়ার, ওয়াইন, হেরোইন, প্যাথেলিন, মারিজুয়ানা, ডেক্রপরটেন, প্যাথেডিন কোকেন, ইকসটামি, এলএসডি, ইলিকসার চোলাইমদসহ রকমারি মাদকের সঙ্গে তরুণদের সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে মাদক হিসেবে ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা নামের এক ধরনের উত্তেজক ট্যাবলেট। এ ছাড়াও হেরোইন, গাঁজা এবং ফেনসিডিলের ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ লাখ। তাদের মধ্যে ৭০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, মাদক সেবনের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখ মানুষ এবং বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে দেড় লাখ মাদকসেবী মারা যাচ্ছেন। বাস্তবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। একজন মাদকাসক্ত সন্তানের কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাদকাসক্ত সন্তানকে নিয়ে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ছে। এমন কি মাদক গ্রাাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। ইদানীং শিশু-কিশোরদের মধ্যে নানা ধরনের মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। পথ শিশুরাও আজ ড্যান্ডি নামক ভয়াবহ নেশায় আসক্ত হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের এক গবেষণায় দেখা যায়, শহর, গ্রাম থেকে নিয়ে স্কুল-কলেজ এবং ভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও মাদকাসক্ত। নামী-দামী অনেক কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোতেও চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। প্রতিনিয়িত বসছে নেশার আড্ডা। অনেকে নেশার টাকা জোগাড় করতে নেমে পড়ছে অপরাধ জগতে। আবার কোন কোন ভার্সিটির ছাত্রীরা মাদকের টাকা সংগ্রহের জন্য ঘৃণিত দেহ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকের চাহিদা মেটাতে তরুণ-তরুণীরা ক্রমেই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছেন। অনেক শিক্ষার্থী নেশার মোহে পড়ে সম্ভাবনাময় জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন। আজ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, মরণ নেশা মাদকের ছোবলে দেশ ও জাতির আশা-ভরসাস্থল তারুণ্য শক্তি অন্ধকারের অতল গহব্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। চলার পথে ঘোর আঁধার নেমে আসছে।
মাদকের ভয়াবহতা শুধু সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক জীবনকে ধ্বংস করে তা নয় মাদকসেবীর জীবনকে ধ্বংস করে বিভিন্নভাবে। কিডনি, লিভার, ফুসফুস নষ্ট করে দেয়া, রক্তচাপ বাড়ানো ও সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতাকেও নষ্ট করে। মাদকাসক্তির পেছনে বহু কারণের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা, দারিদ্র্যতার কষাঘাত, বেকারত্বের নৈরাশ্যত এবং মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা। মাদকের এই ভয়াবহ ছোবল থেকে দেশের তরুণ ও যুব সমাজকে বাঁচাতে প্রয়োজন মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ও সচেতনতামূলক সভা। পাশাপাশি মাদকের মূল গডফাদার থেকে শুরু করে এর বিক্রেতা, পাচারকারী, সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারী সবার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার থেকে