ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

আমার বাবা, আমার পথচলার প্রেরণা

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৯ আগস্ট ২০১৭

আমার বাবা, আমার পথচলার প্রেরণা

একটি শিশু জন্ম নিয়ে এ পৃথিবীর আলো বাতাস দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার আশপাশে যে পুরুষটিকে সে সবচেয়ে বেশি দেখে সে তার ‘বাবা’। জন্মের পর প্রকৃতির নিয়মেই পরম মমতা আর যতনে বাবা-মা মিলেই তাদের সন্তানকে লালন পালন করেন। তবে মায়ের স্থানটি ভিন্ন। সন্তান লালনে মায়ের ভূমিকাই বেশি উচ্চকিত। একই সঙ্গে শিশুটির বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাবার সাহচর্যে তার ঘনিষ্ঠতা, বন্ধন দৃশ্যমান ও দৃঢ় হতে থাকে। আমার অভিজ্ঞতা বলে কোন শিশু যদি পুত্র সন্তান হয় তবে তার ওপর তার বাবার প্রভাব দিন দিন বাড়তে থাকে। বাবার বৈশিষ্ট্য তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। জীবনের পথে চলতে বাবার ধ্যান দর্শন তার জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। আমি এমন একজন বাবার কথা বলছি যিনি পিতা হিসেবে ছিলেন এক আদর্শবান নৈতিক পুরুষ। নিজ স্ত্রীর প্রতি তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গেও তার গড়ে উঠেছিল অনন্য এক মায়া-মমতা ও ভালবাসার বন্ধন। গতকাল ছিল সেই বাবার মৃত্যু দিবস। ২০১২ সালের এই দিনে (২৮ আগস্ট) তিনি ৮৬ বছর বয়সে জাগতিক সব বন্ধন ছিন্ন করে পরলোকগমন করেন। যার কথা বলছি তিনি আমার আদর্শ ও পথপ্রদর্শক পরম শ্রদ্ধেয় পিতা সাবেক গণপরিষদ সদস্য ডাঃ আখলাকুল হোসাইন আহমেদ। কোন সন্তানই তার পিতা-মাতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোন স্মৃতি কখনও বিস্মৃত হয় না, হওয়া যায় না। বরং পিতা-মাতার ধ্যান-জ্ঞান চর্চিত চেতনাই তাদের উত্তরসূরির মাঝে অনুরণিত হয়। চিরন্তন এই সত্যটি আমাকেও তাড়িত করে। আমিও ভুলিনি। আমার হৃদয়ে আমার বাবার শত সহস্র স্মৃতি এখনও সজীবভাবে চিত্রিত। আমরা ভাই-বোনেরা বাবাকে ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করতাম। মা বেঁচে আছেন। তাকে ‘আম্মা’ বলে সম্বোধন করি। রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে আব্বা সরকারী চাকরি করতেন। আমি যখন ৭-৮ বছরের শিশু আমার আব্বা তখন নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানাধীন একটি প্রত্যন্ত গ্রাম নাজিরগঞ্জে একটি দাতব্য চিকিৎসালয়ের ‘মেডিক্যাল অফিসার’ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। শৈশবে আমার একটি তিন চাকার সাইকেল ছিল। প্রতিদিন বিকেলে সাইকেল চালাতাম। আব্বা তার অফিসের পিয়নকে দিয়ে মগ্রা নদী-তীরে খোলা জায়গায় একটি বড় বৃত্ত করিয়ে দিয়েছিলেন। আব্বার নির্দেশ ছিল আমি যেন ওই বৃত্তের ভেতরেই সাইকেল চালাই। অর্থাৎ আব্বা চেয়েছিলেন তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণাপ্রসূত অনুশাসনের মধ্যেই যেন তার সন্তান থাকে, বেড়ে ওঠে এবং এর বাইরে যেন না যায়। ওই বৃত্তের মাঝে সাইকেল চালানোর সময় পিয়ন দাঁড়িয়ে থাকত। ১৫-২০ মিনিট সাইকেল চালানোর পর পিয়ন ‘নিজাম ভাই’ আমাকে নিয়ে ছোট্ট কুটির সমেত আব্বার সরকারী বাসায় ফিরতেন। তখনকার দিনে টেলিভিশনের প্রচলন বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় আদৌ শুরু হয়নি। তাই সন্ধ্যে নামার পর লেখাপড়ার কাজ সেরে আব্বার কাছে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনতাম। ছোট ভাই সাজ্জাদ তখন বেশ ছোট। সে এবং আমার বোন (সাজ্জাদের সঙ্গে যমজ বোন) আম্মার সঙ্গে ঘুমাত। মনে পড়ে, আব্বা সেই গ্রামীণ এলাকায় বাস করেও ‘মার্কিন পরিক্রমা’ নামে একটি ম্যাগাজিন রাখতেন। এটি সম্ভবত ছিল একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন। পরে জেনেছি এটি তৎকালীন র্পূব-পাকিস্তানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে প্রকাশিত হতো। আব্বা আমাকে এটি পড়তে বলতেন এবং এই পাক্ষিকে প্রকাশিত লেখা থেকে নানা প্রশ্ন করতেন। দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় একটু একটু করে ওই পাক্ষিকটি পড়তে চেষ্টা করতাম। এখন মনে হয়, ওই পাক্ষিকের সঙ্গে আমাকে পরিচিত করার পেছনে আব্বার উদ্দ্যেশই ছিল আমার মাঝে পুস্তক পাঠ ও জ্ঞান অর্জনের প্রবণতা সৃষ্টি। কিছুদিন পর আমরা মোহনগঞ্জ থানা সদরে চলে আসি। আমাদের শৈশব কাটে সেখানেই। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে আব্বা চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে যোগদান করেন। পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেত্রকোনা মহকুমা শাখার সদস্য হন। এরপর ১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মোহনগঞ্জ-বারহাট্টা আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় অসীম উদ্দীপনায় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে সক্রিয়ভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর পর স্থানীয়ভাবে তারই নির্দেশে থানা থেকে অস্ত্র এনে নারী-পুরুষ অনেকেই স্থানীয়ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। সম্ভবত দিনটি ছিল ১৭ এপ্রিল ১৯৭১। আমার আব্বাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে এবং তাঁর জীবনের নানা দিক তুলে ধরে স্মৃতিচারণ করতে গেলে অনিবার্যভাবে ১৯৭১ এর মহান মুুক্তিযুদ্ধ সামনে চলে আসে। একই সাথে মুুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে থাকা আব্বার অনেক স্মৃতি আমাকে আমাদের ভাই-বোনদের সবাইকে সামনে এগিয়ে যেতে পথ দেখায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যেতে অবিচল রাখে। ১৯৭১-এর মে মাসের শেষের দিকে আমাদের ভাটি অঞ্চলের হাওড় জলমগ্ন হতে শুরু করে। মনে পড়ে, এমনই একদিন আমার আব্বা আটপাড়ার এমপিএ আব্দুল খালেক সাহেব, নেত্রকোনার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জোহা এবং নেত্রকোনার অপর এক আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ হাফিজ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে নদীপথে রওনা দিয়ে ভারতের মেঘালয়ের মহেষখোলা পৌঁছান। (ডাঃ হাফিজ সাহেব অবশ্য পরে নেত্রকোনায় ফিরে এসেছিলেন)। আমি আজও সেই দিনটির কথা বিস্মৃৃত হইনি। আমার দাদু (আমার আব্বার মা) তখনো বেঁচে ছিলেন। দাদুর ধারণা তিনি বোধহয় তার একমাত্র পুত্রকে আর দেখতে পারবেন না। পরিবারের আমরা সবাই এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লাম। আমার মা ও আমাদের মনেও শঙ্কা কাজ করছিল আমরা কি আমার আব্বাকে আর কোনদিন ফিরে পাব? বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানীরা বন্দী করেছে। তিনি আর ফিরতে পারবেন কিনা সেটিও ছিল অনিশ্চিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসীম সাহসী নেতৃত্বে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন ভূখ- প্রিয় জন্মভূমি ‘বাংলাদেশ’। কোনভাবেই তাই সেদিনের কোন স্মৃতিই হৃদয় থেকে হারিয়ে যায়নি। আমার আব্বাও ছিলেন এসব স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। জানলাম কলকাতায় অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু এর পরিণতি সম্পর্কে তখন কোন সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের ছিল না। ঠিক এ রকম এক অবস্থায় আমার আব্বার স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ সত্যিই ছিল এক অনন্য সাহসী পদক্ষেপ। কেননা সদ্য সরকারী চাকরিত্যাগী, যার আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই তখনও মুসলিম লীগ, পিডিপির রাজনৈতিক নেতা বা সমর্থক, এমন একজন মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মা, স্ত্রী ও সন্তানদের এক অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এটি আদৌ কোন সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। গভীর দেশপ্রেম ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। সন্তান হিসেবে আব্বার এই বিরল দেশপ্রেম ও সাহসের জন্য আমি গর্ব অনুভব করতেই পারি। সম্ভবত আজকালকার মানসিকতায় বেড়ে ওঠা অনেকের পক্ষেই এমন সাহসী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হতো না। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে মা আমাদের চার ভাইবোনকে নিয়ে ভারতের মেঘালয়ের মহেশখোলায় পাড়ি জমান। তারিখটা ছিল ১৪ আগস্ট ১৯৭১। আমাদের সঙ্গে ছিলেন আমাদের মেজ মামা ও আরও ক’জন আত্মীয়স্বজন। হাওড়ের বুক চিড়ে ভয়াল ঢেউ উপেক্ষা করে অবশেষে আমরা গারো পাহাড়ের কোলে মহেশখোলায় পেঁৗঁছাই। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। মনে পড়ে, আব্বা কয়েকজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকক্ষণ আমাদের জন্য ঘাটে অপেক্ষা করছিলেন। অনেকদিন পর আব্বাকে পেয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। ছোট ভাই দুই বছর বয়সী সাইফুল হাসান সোহেল লাফিয়ে আব্বার কোলে ওঠে। সেদিনের কথা কেমন করে ভুলি? ঘাট থেকে মিনিট পনেরো পরে আমরা মাচাংয়ের উপর তৈরি ছন ও নলখাগড়ার ঘরে পৌঁছাই। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত মহেশখোলার ওই কুঁড়ে ঘরই ছিল আমাদের শরণ। আমাদের সঙ্গে থাকতেন নেত্রকোনার বিশিষ্ট কবি ও লেখক খালেকদাদ চৌধুরী, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আমীর উদ্দিন আহমেদ, মামা খুররম খান চৌধুরী ও ফুফাত ভাই দেলোয়ার হোসেন। লেখক : বিচারপতি
×