ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জকিগঞ্জে ২ শতাধিক গ্রাম এখনও প্লাবিত ॥ মাছের খামারে ক্ষতি ২১৭৩ কোটি টাকা

সিলেট নগরীর পানি নামছে ॥ সুনামগঞ্জ হাওড়বাসীর দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ২২:২৫, ২৩ মে ২০২২

সিলেট নগরীর পানি নামছে ॥ সুনামগঞ্জ হাওড়বাসীর দুর্ভোগ

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ বন্যার পানি কমছে। রবিবার কখনও রোদ, কখনও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। নগরী থেকে ৮০ শতাংশ বানের পানি নেমে গেছে। বাসাবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি দ্রুত নেমে যাচ্ছে। তবে নিম্নাঞ্চলের কিছু সড়ক ও বাসাবাড়িতে এখনও পানি রয়ে গেছে। বন্যায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মাছের খামারের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। কৃষকরা আউশ ফসলের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ১১টি উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দীঘি, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে বলে মাছ মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে খামারের। বন্যায় ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে, নগরীর বাসাবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি নামার পর জমে থাকা ময়লায় চরম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। একই সঙ্গে পানিতে ভিজে আসবাবপত্রের ক্ষতি হয়েছে। বাসাবাড়ি, দোকানপাট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন সংশ্লিষ্টরা। পানি নেমে যাওয়ায় নগরীর পরিস্থিতির উন্নতি হলেও উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। জেলায় বন্যার পানি কোথাও বেড়েছে, আবার কোথাও অল্প কমেছে। গত শুক্রবার রাতে ভেঙ্গে যাওয়া জকিগঞ্জের অমলশিদ এলাকায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থলের বাঁধ দিয়ে প্রবল বেগে পানি ঢুকছে। ওদিকে, নতুন করে ভাটির দিকে চাপ বেড়েছে পানির। এদিকে, তিন নদীর মোহনায় বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় জকিগঞ্জে ২৯৩টি গ্রামের মধ্যে দুই শতাধিক গ্রামই এখন প্লাবিত। সব মিলিয়ে উপজেলার প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। প্লাবিত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য মানুষ হাহাকার করছে। জকিগঞ্জ ছাড়াও পানি বেড়েছে বিশ্বনাথ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়। গত দুইদিনে এসব উপজেলায় অন্তত ১৫ থেকে ২০টি গ্রাম নতুনভাবে প্লাবিত হয়েছে। জেলার অন্যান্য উপজেলার কোথাও পানি কমেছে, কোথাও পানি বাড়ছে। বানভাসি মানুষরা জানিয়েছেন, কিছু এলাকায় পানি কমলেও তার পরিমাণ খুব কম। ফলে ঘরবাড়ি থেকে পানি এখনও সরেনি। এ অবস্থায় ভোগান্তি ঠিক আগের মতোই আছে। গত দুদিন কমার পর রবিবার আবার বাড়ছে সিলেটের সুরমা নদীর পানি। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার বেড়েছে। তবে সিলেট পয়েন্টে এ নদীর পানি অপরিবর্তিত আছে। অপরদিকে, ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে কুশিয়ারার পানি বাড়ায় বাঁধ ভেঙ্গে ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ নতুন করে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলছেন, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আর খুব একটা অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। ৪/৫ দিনের মধ্যে বেশিরভাগ এলাকা থেকেই পানি নেমে যাবে। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ায় বানভাসিদের সঙ্কট আরও বেড়েছে। ত্রাণ নিয়ে হাহাকারও দেখা দিয়েছে অনেক জায়গায়। এখন পর্যন্ত ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকে। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক ও মৎস্যজীবীরা। বোরোর পর তলিয়ে গেছে আউশ ধানের বীজতলা। এ ছাড়া ভেসে গেছে হাজারও খামারের মাছ। ১৪০টি মেডিক্যাল টিম ॥ এদিকে, বন্যায় সিলেটে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে জানিয়ে সিলেটের সিভিল সার্জন ডাঃ এস এম শাহারিয়ার বলেন, ইতোমধ্যে শতাধিক লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আমরা পেয়েছি। চর্মরোগও বাড়ছে। পানি কমলে রোগবালাই আরও বাড়তে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, পানিবাহিত রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, এ জন্য আমরা এরই মধ্যে ১৪০টি মেডিক্যাল টিম গঠন করেছি। তারা বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার্তদের সেবায় কাজ করছে। ত্রাণের কোন সঙ্কট নেই ॥ ত্রাণের কোন সঙ্কট নেই জানিয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোঃ মজিবর রহমান বলেন, শনিবার পর্যন্ত বন্যার্তদের মাঝে ৩২৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৫ লাখ টাকা ও সাড়ে ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখনও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ত্রাণ দেয়া হবে। ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি ॥ আকস্মিক বন্যায় সিলেটের ১১টি উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দীঘি, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে মাছ চাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও হয়েছে অবকাঠামোগত ক্ষতি। এর ফলে সিলেট জেলার ১৫ হাজার ১৬৩ জন খামার মালিকের ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম আজাদ। এদিকে, বন্যায় মাছের খামার, পুকুর ও দীঘি তলিয়ে মাছ চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অনেক এলাকায় বন্যার পানিতে মাছ ধরার হিড়িক পড়েছে। খামার থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাছ ধরা পড়ছে বিভিন্ন এলাকায় লোকজনের জালে। বন্যাকবলিত প্রায় প্রতিটি স্থানে অবাধে শিশু-কিশোর ও যুবককে ছোট ছোট জাল নিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে। সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে সুরমা নদীর পানি সিলেটের সব পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্লাবিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, রবিবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা পয়েন্টে ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর ও সিলেট নগরী পয়েন্টে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি সিলেটের জকিগঞ্জের অমলশীদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপর এবং বিয়ানীবাজারের শেওলা পয়েন্টে ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিদ্যুতের তারের ওপর ঝড়ে ভেঙ্গেপড়া গাছ ॥ সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৩নং ওয়ার্ডের মেন্দিবাগস্থ লতিফিয়া হাউজিংয়ের সাদিপুর ২য় খন্ড নওয়াগাঁও এলাকায় কয়েক দিন থেকে একটি কদম গাছ বিদ্যুতের তারের ওপর পড়ে রয়েছে। রাস্তা দিয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে পথচারী ও যানবাহন। যে কোন মুহূর্তে ঘটতে পারে প্রাণহানির মতো ঘটনাও। চালের আড়তে কোটি টাকার ক্ষতি ॥ এক সপ্তাহ পর বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও ব্যাপক লোকসানে ফেলে দিয়েছে ব্যবসায়ীদেরকে। ধান-চাল নিয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে। সিলেট নগরীর সুরমা নদী তীরবর্তী ধান-চালের মিল ও আড়তে গুদামজাত করে রাখা কোটি টাকার ধান-চাল নষ্ট করেছে বন্যার পানি। সুরমার উত্তরপাড়ের নগরীর কাজিরবাজার ধান-চালের মিল ও আড়তের গুদামগুলোর অনেকটিতেই ছিল কোমর পানি। গুদামে রাখা সারি সারি ধান-চালের বস্তা ভিজে নষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে। সুনামগঞ্জে হাওড়পাড়ের গ্রামগুলোতে দুর্ভোগ বেড়েছে ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা সুনামগঞ্জ থেকে জানান, নদীর পানির কমলেও হাওড়পাড়ের গ্রামগুলোতে দুর্ভোগ বেড়েছে। গেল ১০/১২ দিনের লাগাতার বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নাভিশ্বাস অবস্থা চলছে হাওড়ের জনপদে। অনেক সড়ক ডুবে আছে, সড়কের ওপর দিয়ে যানবাহন চলছে না, আবার নৌকাও যাচ্ছে না, তাতে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা দেয়া হচ্ছে বলা হলেও বন্যাদুর্গতরা বলছেন, তারা ত্রাণ পাচ্ছেন না। সরকারী-বেসরকারী যে সব ত্রাণ যাচ্ছে, তা কেবল শহর ও শহরতলিতে পৌঁছাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের বন্যকবলিতরা তা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হেসেন তা অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি ও পৌর মেয়র নাদের বখত রাতেও মানুষের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বললেন, রবিবার আবহাওয়া একই ধরনের থাকবে। তবে ২৩, ২৪ ও ২৫ মে বৃষ্টি কমবে। এই তিনদিন উজানেও (মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতে) বৃষ্টি কম হবে। স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, আবহাওয়ার বৈচিত্র্যতায় কুড়িগ্রাম জেলায় অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। শহরের বিভিন্ন মহল্লায় ও পাড়ার অলি গলিতে পানি জমে গেছে। সিলেটবাসীর পাশে থাকার আশ্বাস পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ॥ বন্যাপরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সিলেটবাসীর পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেছেন। সিলেট নগরীসহ পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। তবে বন্যাপরবর্তী সময়ে কবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দেয় নানা সমস্যা। বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। রবিবার সিলেট সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তৃতাকালে সিলেট-১ আসনের এই এমপি এমন আশ্বাস প্রদান করেন।
×