ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সেচ খরচ সাশ্রয় একশ’ কোটি টাকা

তিস্তা কমান্ড এলাকায় ৭০ হাজার হেক্টরে বোরোর বাম্পার ফলন

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২২ মে ২০২২

তিস্তা কমান্ড এলাকায় ৭০ হাজার হেক্টরে বোরোর বাম্পার ফলন

স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় তিন জেলায় এবার ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষের বাম্পার ফলন হয়েছে। সেচ খালের পানিতে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এটা সর্বোচ্চ চাষাবাদ। কারণ, সেচ খাল থেকে নামমাত্র খরচে পানি পেয়েছে কৃষকেরা। এতে ছয় লাখ কৃষকের সেচ বাবদ প্রায় ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। শনিবার নীলফামারীর ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, এবার রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলা তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় এসেছে। এগুলো হলো রংপুর সদর, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া; নীলফামারী সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ, সৈয়দপুর এবং দিনাজপুরের পার্বতীপুর, চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলা। নীলফামারীতে ৩০ হাজার, রংপুরে ২৫ হাজার ও দিনাজপুর জেলায় ১৫ হাজার হেক্টরে বোরো চাষ হচ্ছে ওই সেচ খালের পানিতে। এর আগে বোরো মৌসুমে তিস্তা সেচ খালের পানি দিয়ে ২০১৪ সালে ১৮ হাজার হেক্টর, ২০১৬ সালে ১০ হাজার, ২০১৭ সালে ৮ হাজার, ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার, ২০১৯ সালে ৪০ হাজার ও ২০২১ সালে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এবার ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হয়। পাউবোর উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ আবদুল হাকিম বলেন, বৈদ্যুতিক মোটর কিংবা ডিজেলচালিত যন্ত্রের সাহায্যে পানি সেচ দিলে কৃষকদের একরপ্রতি খরচ গুনতে হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। এতে ৭০ হাজার হেক্টরে সেচ বাবদ খরচ হয়ে যায় ১১০ কোটি টাকা। কিন্তু তিস্তা সেচ খালের পানি ব্যবহার করায় একরপ্রতি কৃষকের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৪৮০ টাকা। এতে ৭০ হাজার হেক্টরে চাষাবাদ করতে সেচ খরচ হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কৃষকের সাশ্রয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী বলেন, প্রকল্পের আওতায় ২৮১টি কৃষক দল রয়েছে। পানি সেচ দেয়া হয় রোটেশন পদ্ধতিতে। পুরো বিষয়টি নজরদারি করে পাউবো। নীলফামারী সদরের রামনগর ইউনিয়ন পরিষদের মাঝাপাড়া গ্রামের কৃষক আলম মিয়া (৫০)। তিনি বলেন, এই যে তিস্তা ক্যানেলে প্রতি বছরের মতো এবারও বোরো আবাদ করেছি। ইচ্ছেমতো সেচ পেয়েছি। সেচ সুবিধা পাওয়া গঞ্জিপুর এলাকার কৃষক রায় বাহাদুর বলেন, ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিনে ও বিদ্যুতচালিত সেচ পাম্প দিয়ে একরপ্রতি বোরো ধান চাষে সেচ খরচ পড়ে কমপক্ষে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্যানেলের পানি নিয়ে আবাদ করতে ওই পরিমাণ জমিতে খরচ হয় ৪৮০ টাকা। পানি ইচ্ছেমতো পেয়েছি, ফলন বেশি হয়েছে। মহিপুরে দেখা যায় সেখানে তিস্তা কমান্ড এলাকার কৃষকরা বোরো ধান কম্বাইন্ড হারভেস্টর মেশিন দিয়ে ধান কর্তন ও ধান মাড়াই করছে। সরেজমিনে দেখা যায় এলাকার প্রতিটি কৃষকের ঘরে-বাইরে এখন শুধু ধান আর ধান। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি এড়িয়েও বাম্পার উৎপাদন হয়েছে বলে জানাল কৃষি বিভাগ। এতে শুধু রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলায় সম্ভাব্য উৎপাদন আশা করা হচ্ছে ২২ লাখ ৭ হাজার ১৩২ মেট্রিক টন চাল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, চলতি মৌসুমে রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলা নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় বোরো চাষ হয়েছে ৫ লাখ ৫ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে নীলফামারী জেলায় ৮১ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে বোরোর আবাদ। কমান্ড এলাকার দক্ষিণ কাঁঠালীর এলাকার কৃষক আলী আকবর জোর গলায় বললেন তিস্তার সেচে তিনি ৭ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করে ১৮২ মণ ধান ঘরে তুলেছে। তিস্তার প্রধান সেচ খালের বগুলাগাড়ী আর থ্রিটি রেগুলেটরে পরিদর্শন সড়কে দেখা যায় অনেক কৃষক সেখানে ধান মাড়াই করছে। এদের মধ্যে আব্দুল হামিদ সরকার বললেন ঝড়বাদল শিলাবৃষ্টি হলেও আমাদের তিস্তা সেচ প্রকল্পের এলাকার কোন জমির ধান নষ্ট হয়নি। আরও অনেক কৃষক জানায়, তারা বিঘাপ্রতি কেউ ২৫ মণ কেউবা ২৮ মণ পর্যন্ত ধান পেয়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় তারা সেচের পানি দিয়ে গত এক দশক থেকে বাম্পার ফলন ফলিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে। সম্প্রতি নীলফামারীতে তিন দফায় কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বেশ কিছু জমির বোরো ধান বিনষ্ট হয়। তবে খাদ্য উৎপাদনে জাতীয়ভাবে এর কোন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। বোরো ধান সেচনির্ভর। মৌসুমের শুরুতেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় এ বছর বোরো আবাদে পানি সঙ্কট হয়নি। তাই ফলনও ভাল হয়েছে। মাঠে মাঠে ধান কাটা আর মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে কৃষকের। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে উঠেও তিস্তা সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকা ছাড়াও বিদ্যুত ও ডিজেলচালিত সেচ পাম্পে যে সকল কৃষক বোরো ধান আবাদ করেছে তারাও এক বাক্যে বলছে এবার বাম্পার ফলন পাওয়া গেছে। দেখা যায় কেউ ধান হাত দিয়ে মাড়ছে কেউ মাড়াই মেশিনে। রাস্তায় রোদে শুকাচ্ছেন কৃষক-কৃষাণিরা।
×