ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর সমবায় দর্শন

প্রকাশিত: ২০:৪০, ৩০ মার্চ ২০২২

বঙ্গবন্ধুর সমবায় দর্শন

১৯৭২ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সম্মেলনে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের সমবায় আন্দোলন হবে সাধারণ মানুষের যৌথ আন্দোলন। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান।... জেলে সমিতি, তাঁতী সমিতি, গ্রামীণ কৃষক সমিতি যেন সত্যিকারের জেলে, তাঁতি, কৃষকের সংস্থা হয়-মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী বা ধনী কৃষক যেন আবার এই সমিতিগুলোকে দখল করে অতীত দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি না করে।’ স্বাধীনতার আগে ষাটের দশকে এদেশে সমবায় আন্দোলন তেমন জোরদার ছিল না। সমিতির সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। সদস্যসংখ্যা ছিল খুব কম। কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সহায়তায় গ্রামীণ ক্ষুদ্র ঋণ ও কৃষি সমবায় প্রসারিত হচ্ছিল দেশের সীমিত কিছু এলাকায়। পানি সেচ ও উচ্চ ফলনশীল ফসলের আবাদ উৎসাহিত করা হচ্ছিল বিভিন্ন গ্রামে। সরকারীভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প। তখন দেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে এসবের প্রভাব ছিল খুব কম। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমবায় আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে প্রণীত দেশের সংবিধানে সমবায় মালিকানাকে দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা-ব্যবস্থা নিম্নরূপ হইবে। (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারী খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা; (খ) সমবায়ী মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায়সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা এবং (গ) ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা।’ বঙ্গবন্ধু দেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে সমবায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এর সদস্য হতো গ্রামের সব মানুষ। তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যৌথ কৃষি খামার। সরকার তাতে ঋণ দেবে, উপকরণ সহায়তা দেবে, সেচের ব্যবস্থা করে দেবে। তাতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়বে। এর সুফল পাবে জমির মালিক, শ্রম প্রদানকারী ভূমিহীন কৃষক ও সরকার। তবে জমির মালিকানা কৃষকেরই থাকবে। এক্ষেত্রে ভয় না পাওয়ার জন্য কৃষকদের তিনি আশ্বস্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি যে, পাঁচ বছরের প্ল্যান, প্রত্যেকটি গ্রামে কম্পলসারি কো-অপারেটিভ হবে। বাংলাদেশে ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেক মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। ভুল করবেন না। এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি তাতে আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব, তা নয়। এ জমি মালিকের থাকবে। আপনার জমির ফসল আপনি পাবেন। কিন্তু ফসলের অংশ সবাই পাবে।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর গ্রামভিত্তিক বহুমুখী সমবায়ের রূপরেখা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু সমবায় আন্দোলন থেমে থাকেনি। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেরণায় সমবায় কর্মসূচী পুনরায় গতি লাভ করে। বর্তমানে এ দেশে ২৯ প্রকারের সমবায় সমিতি রয়েছে। মোট সমিতির সংখ্যা ১,৯৭,০৬৫টি। তাতে অংশগ্রহণকারী সদস্যসংখ্যা ১,১৭,৪২,৬৭৪ জন। এদের একটি বড় অংশ কৃষি সমবায়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কৃষিপণ্যের উৎপাদন করছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের নাগপাশ এড়িয়ে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছে। সমবায়ের মাধ্যমে তারা উন্নত বীজ, সার, সেচ ও কৃষিযন্ত্রের ব্যবস্থা করছে। এক্ষেত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তিনিই দেশের কৃষকদের সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে অধিক উৎপাদন ও লাভজনক বিপণনে উৎসাহিত করেছেন। স্বাধীনতার ৫১ বছরে দেশে সমবায় সমিতির সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ৩.০৯ শতাংশ হারে এবং সদস্যসংখ্যা ২.৮২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমানত ও কার্যকরী মূলধনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৬.৭০ এবং ৯.৭১ শতাংশ। বর্তমানে সমবায় খাতে কর্মসংস্থাান হচ্ছে ৯,৬৩,৮৯২ জনের। এক বিশাল কর্মযজ্ঞ সূচিত হয়েছে দেশের সমবায় খাতে। গত ৫১ বছরে দেশে কৃষির উৎপাদন প্রায় ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে দুধ, ডিম, মাংস ও মাছের উৎপাদন। বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ম্ভর। ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি হেক্টরে ১ টন থেকে ৩ টনে। উচ্চ ফলনশীল জাত সম্প্রসারিত হয়েছে শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ জমিতে। সেচ এলাকা বিস্তার লাভ করেছে ৭৪ শতাংশ ফসলি এলাকায়। এতে সমবায়ের প্রভাব রয়েছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের কৃষির উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়াতে হবে। বিভিন্ন কৃষিপণ্যের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এর জন্য সমবায় আন্দোলনকে আরও জোরদার করা দরকার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতি গ্রামে যৌথ কৃষি খামার গড়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। এর বণ্টন ব্যবস্থা হতো তেভাগা পদ্ধতির। ভাগ পাবে জমির মালিক, শ্রমিক ও সমবায়। এ বিষয়ে ৭০-এর দশকের প্রথম দিকে বেশ কিছু মাঠ পর্যায়ের গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল ময়মনসিংহের শিমলা, কুমিল্লার বামইল, রাজশাহীর গুরুদাসপুর এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া গুমাইবিল প্রকল্প। গবেষণায় দেখা গেছে ফল ইতিবাচক। তাতে উৎপাদন বেড়েছে। শ্রমিক তার মজুরি পেয়েছে বেশি। গ্রামীণ আয়ের বন্টনে উন্নতি হয়েছে। বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। তবে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে যৌথ খামার কর্মসূচী আর এগিয়ে যেতে পারেনি। তবে সর্বজনীন ও সর্বাঙ্গীণ গ্রাম উন্নয়ন তথা কৃষি উন্নয়নের জন্য তা আজও প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি সমবায় বিভাগ প্রণীত বঙ্গবন্ধু মডেল ভিলেজ প্রকল্প তা মাঠ পর্যায়ে প্রতিপাদন করতে পারে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনপ্রতি আয় ছিল ১০০ মার্কিন ডলারের নিচে। অর্ধশতাব্দী পর এখন তা উন্নীত হয়েছে ২,৫৯১ মার্কিন ডলারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে গত ১৩ বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ হারে। ১৯৭২ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশ। একটি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থাান করে নিয়েছে। তবে আয় বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বরং অবনতি ঘটেছে। আমরা সেই ক্রান্তিকালে আছি। অতএব, এ বৈষম্য কমাতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে আয় বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উন্নয়নের প্রতি সমবায়কে যতœবান হতে হবে। বর্তমানে মানুষে মানুষে বৈষম্য বিরাজমান। বৈষম্য রয়েছে গ্রাম ও শহরের জীবনধারায়। এগুলো দূর করতে হবে। এর জন্য দরকার গ্রামীণ অর্থনীতিকে বহুমুখী করা, কর্মসংস্থাান বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করা, পুঁজি গঠন ও আয়বর্ধক কর্মসূচী গ্রহণ করা, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা, বাসস্থানের সংস্থান বাড়ানো ইত্যাদি। সমবায়ের মাধ্যমে তা কার্যকরভাবে সম্পাদন করা সম্ভব। রূপকল্প ২০২১-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ লক্ষ্যগুলো অর্জনে আমরা পুরোপুরি সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে রূপকল্প ২০৪১ অনুসারে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ। তখন জনপ্রতি আয় দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। নিরষ্কুশ দারিদ্র্য প্রায় বিলুপ্ত হবে। চরম দারিদ্র্যের অবসান ঘটবে। দেশের নাগরিকদের অভাব প্রায় থাকবে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে সমবায়। অতএব, রূপকল্প ২০৪১-এর বাস্তব রূপায়ণ ও আয় বৈষম্য হ্রাসের জন্য সমবায়কে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেতে-খামারে দ্রুত উৎপাদন বাড়ছে। তাতে সমস্যাও বাড়ছে। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। বিপণন প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছে এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া ও ব্যবসায়ী। উদাহরণস্বরূপ, উৎপাদন মৌসুমে ধানের মূল্য থাকে প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। পরে তা ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় বৃদ্ধি পায়। তখন কৃষকের ঘরে আর বিক্রিযোগ্য ধান থাকে না। এর লাভ পুরোটাই নিয়ে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, চালের আড়তদার ও চাতালের মালিক। বেগুন উৎপাদন করে শেরপুরের কামারের চরের কৃষকরা প্রতি কেজি বিক্রি করে ৮ থেকে ৯ টাকায়। ঢাকায় তা খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হয় ৫০-৬০ টাকায়। দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। ঢাকায় তা কিনতে হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে মিল্কভিটার মাধ্যমে দুগ্ধ বাজারজাতকরণের সুবিধা থাকার জন্য। সুনামগঞ্জের হাওড়ে সেই সুবিধা নেই। দুধের উৎপাদনেও তেমন লক্ষণীয় কোন উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কাজেই দেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য লাভজনক বিপণন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সমবায়ের মাধ্যমে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমবায়ভিত্তিক বিপণনের বহু উদাহরণ আছে। ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, ভারত সর্বত্রই সমবায়ভিত্তিক বিপণনের প্রাধান্য রয়েছে। নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কৃষিজাত পণ্য সমবায়ের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে এর অবস্থান দুর্বল। এক্ষেত্রে আর্থিক উন্নয়ন এবং সমবায়ভিত্তিক বিপণন ও উৎপাদনের পর্যাপ্ত সুযোগ বিদ্যমান। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি অগ্রগামী দেশ। বিশে^র অনেক দেশের কাছেই এক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষা, গবেষণা, রাজনীতি, প্রশাসন, পররাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে সমবায় সমিতিতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনও কম। বাংলাদেশে মোট সমবায়ীর সংখ্যা ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৩ হাজার। এর মধ্যে ২৩/২৪ শতাংশ নারী। এটা বাড়াতে হবে। দেশের অনেক অনানুষ্ঠানিক সমবায় সমিতির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের হিস্যা ৭০/৮০ শতাংশ। আনুষ্ঠানিক সমবায়ের ক্ষেত্রেও তা অনুসরণযোগ্য। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ সমবায়ের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। চিরায়ত সমবায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য ক্ষুদ্র ঋণ উদ্ভাবন। ব্রিটিশ আমল থেকেই এদেশে চালু রয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ ও সঞ্চয়। বাংলাদেশে প্রাথমিক সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি, প্রাথমিক কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন এবং প্রাথমিক কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সমবায় সমিতি ইত্যাদি ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে এ ধরনের সমিতির সংখ্যা ১২,৩৮১। সদস্যসংখ্যা ১৪,৪২,৫১৩ জন। তারা নিজেরা সঞ্চয় করে, ঋণও দেয়। চীনে শতকরা ৮৫ ভাগ কৃষি ঋণ সমবায়ভিত্তিক। বাংলাদেশেও এর সম্প্রসারণ ঘটছে। তবে বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। এর প্রতিকারও আছে। গণতন্ত্রায়ন ও স্বচ্ছতা সমবায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে দুর্নীতি থাকবে না। বর্তমান বিশে^র মানুষ এক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার অভিযাত্রী। এখানে পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রধান অবলম্বন সমবায়। আমাদের দেশের সমবায় চিন্তকদের অবশ্যই ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের স্বার্থে কাজ করতে হবে। আন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন নিশ্চিত করার একটি কৌশল হচ্ছে সমবায়। এটি শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, মানবিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের নির্ভরযোগ্য একটি অবলম্বনও। এটি সততা প্রতিষ্ঠা এবং মনন ও মানসিকতা পরিবর্তনের উত্তম পন্থা। সমবায় সুপ্রতিষ্ঠিত হলেই সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রান্তিক জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যাবে। এর জন্য দেশে সমবায় আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষায় ‘দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে সমবায় একটি পরীক্ষিত কৌশল।’ লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ, প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, একুশে পদকপ্রাপ্ত
×