ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অলোক আচার্য

কবিতায় ভাষা ও ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ০০:৩২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

কবিতায় ভাষা ও ভাষা আন্দোলন

‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়/নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়- ভাষা নিয়ে এই বিখ্যাত উক্তিটি কবি আব্দুল হাকিমের বঙ্গবাণী কবিতার অংশ বিশেষ। নিজ মাতৃভাষা যারা ভালোবাসে না তাদের সেই দেশেও থাকার অধিকার থাকে না। ভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর সেটা হলো মাতৃভাষা। মাতৃভাষার গুরুত্ব পৃথিবীর সবদেশে, সবকালে সব ধরনের লেখক, কবি, গায়ক, নাট্যকার, পরিচালকের কাছে। আমাদের বাংলা ভাষা মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে রয়েছে এক মহান ইতিহাস। রয়েছে মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা বিশে^ এ দিবস পালিত হয়। বিশ^বাসী জানে ভাষার জন্য আমরা কতটা রক্ত দিয়েছি। সেই ইতিহাস ঘিরে আজও সাহিত্যকর্ম প্রস্তুত হচ্ছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকবে। এ সবকিছুর মূলে রয়েছে ভাষা, মাতৃভাষা বাংলা। ভাষা এমন এক মহাসম্পদ তা আগলে রাখার দায়িত্ব সকলের। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে কবির কবিতায়, গল্পকারের গল্পে, ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে, ছড়াকারের ছড়ায়, প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম তৈরি হয়েছে এবং সেই চর্চা আজও অব্যাহত আছে। বাংলা ভাষা আমাদের কাছে গর্ব। আমাদের প্রাণস্বরূপ। অতুল প্রসাদ সেন তাই যথার্থই বলেছেন, ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা/তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা/কি যাদু বাংলা গানে/গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে/গেয়ে গান নাচে বাউল/গান গেয়ে ধান কাটে চাষা! ভাষার সাথেই আমাদের জীবন বাধা। ভাষাতেই মুক্তির আনন্দ। কবির কলমে বারবার এসেছে বাংলা ভাষার কথা। এসেছে ভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সেই অমর একুশের কথা। জন্মের পর মা’র মুখে যে ভাষা শুনি তা-ই আমাদের অন্তর সুধা। নিজ ভাষা ছাড়া আর অন্য কোনো ভাষায় অন্তর তৃপ্তি লাভ সম্ভব না। রামনিধি গুপ্ত (নিধি বাবু) এ সত্য উপলদ্ধি করে সেই কবেই বলেছেন, নানান্ দেশে নানান্ ভাসা (ভাষা)/বিনা স্বদেশী ভাষা/পুরে কি আশা? সত্যিই তো, স্বদেশীয় ভাষা ছাড়া কি মনের আশা কোনদিন মিটতে পারে? মেটে না। মিটে না জন্যই কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আমরা আজ পেয়েছি। নিজেকে যখন বিদেশী ভাষার মোহে হারিয়ে ফেলেছিলেন তখন কেবল মাতৃভাষা এবং দেশের টানে আবার ফিরে এসেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। প্রথম জীবনে বিদেশী ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কবি পাড়ি জমান ভিন দেশে। তখন বাংলা ভাষার প্রতি কবির টান না থাকলেও বিদেশে অর্থাৎ ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে থাকাকালীন কবির নিজ ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মে। ইংরেজী ভাষায় সাহিত্য রচনায় সেদেশের সাহিত্য মহলে দৃষ্টি কাড়লেও তার মেধার মূল্যায়ন পুরোপুরিভাবে হচ্ছিল না। এরপর তিনি মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। এবং একের পর এক মহামূল্যবান সাহিত্য কর্ম উপহার দেন। তার নিজ দেশ, সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রতি অবহেলা তার মনকে বিষণœ করেছে। সে প্রমাণ তার লেখায় পাওয়া যায়। কবির ‘কবি-মাতৃভাষা’ কবিতায় লিখেছে- ‘নিজাগারে ছিল মোর অমূল্য রতন/অগণ্য; তা সবে আমি অবহেলা করি/অর্থালোভে দেশে দেশে করিনু ভ্রমণ। আবার কবির বঙ্গভাষা কবিতায় লিখেছেন, ‘হে বঙ্গ, ভা-ারে তব বিবিধ রতন/তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি/পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি... ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি/এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি? বাংলা ভাষা যে সম্পদে পূর্ণ এক ভা-ার তা কবি প্রথমে উপলদ্ধি করতে পারেননি। মাতৃভাষা, মা এবং দেশ একই সূত্রে গাঁথা। এ সবই আমাদের অমূল্য সম্পদ। আমাদের সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কবিতায় বার বার এসেছে বাংলা ভাষার কথা। বেগম সুফিয়া কামালের ‘জন্মেছি এই দেশে’ কবিতায় এই দেশ, মাটিতেই জন্ম ও মৃত্যু প্রত্যাশা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই বাংলার আকাশ বাতাস/এই বাংলার ভাষা/এই বাংলার নদী, গিরি-বনে/বাঁচিয়া মরিতে আশা। পৃথিবী থেকে বহু ভাষা আজ বিলুপ্ত। হারিয়ে যাওয়ার পথে অনেক ভাষা। আমাদের বাংলা ভাষাও কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানীরা। জীবনের বিনিময়ে সে ভাষার অধিকার রক্ষা করেছি। তবে রক্ষা করেও যেন আমাদের ভাষা আমাদের কাছেই বড় অবহেলার। বেশ আয়োজন করেই সেই ভাষা বাদ দিয়ে বিদেশী ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি। দিনের পর দিন অবহেলার ফলে ভাষা চর্চার অভাবে ভাষার বিকৃতি ঘটছে। চোখের সামনে মায়ের ভাষার এ পরিণতি দেখতে হচ্ছে। বাংলার স্থলে ইংরেজী অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন দেশের জন্য, কোন জাতির জন্য ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক। স্বাধীনতা শব্দটি একটি বিস্তৃত শব্দ যেখানে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার না থাকে তাহলে অপূর্ণ স্বাধীনতা কোন ফল বয়ে আনতে পারে না। আমাদের বাংলা সাহিত্যও সমৃদ্ধ। যেখানে একটি বড় অংশেই রয়েছে নিজ ভাষা চর্চার জয়গান। রয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির রাঙানো ইতিহাসের পটভূমি। বাংলা ভাষায় প্রথম একুশের কবিতা ’কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। কবিতাটি রচনা করেছেন মাহবুব আলম চৌধুরী। এরপর থেকে সব কবির কলমেই একুশের কবিতা রচিত হয়েছে। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন এবং ভাষা নিয়ে একটি কবিতা না লিখলে যেন সাহিত্য জন্ম অপূর্ণ থেকে যায়। কারণ ভাষা প্রেমও তো দেশপ্রেমই। তাই দেশকে নিয়ে কবিতা লিখতে গেলে আসে ভাষার কথা। সেখান থেকে আসে একুশে ফেব্রুয়ারির কথা। রয়েছে রফিক, শফিক, জব্বারদের আত্মত্যাগের কথা। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ তাই আমাদের অহংকার। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তারা। কবি আল মাহমুদের একুশের কবিতায় উঠে আসে সে কথাই। সেখানে কবি লিখেছেন,’ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতের রক্ত। এই কবিতার শেষ চার লাইনে লিখেছেন,’ প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে/বাংলা আমার বচন, আমি/জন্মেছিল এই বঙ্গে। আবার কবি সৈয়দ শামসুল হক তার একুশের কবিতায় লিখেছেন,’ সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়/ি শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ^াস/মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায় বলে গেল সেই কথা।/ সেই কথা বলে গেল অনর্গল-/। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র একুশের পটভূমি নিয়ে লেখা ‘মাগো, ওরা বলে’ কবিতাটি মাধ্যমিকে পাঠ্য। কবিতার বর্ণনা এমনভাবে দেওয়া যে যদি বাংলায় কথা বলার অধিকার না থাকতো, যদি আমাদের সবার কথা কেড়ে নিত তাহলে আজ আমরা বেঁচে থেকেও মৃত হয়ে থাকতাম। এ এক তীব্র যন্ত্রণা! কবিতায় মায়ের আদরের খোকার পকেট থেকে ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা চিঠিতে খোকা বলেছে, মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। বলো মা, তাই কি হয়? এমনটা হতে দিতে চায়নি জন্যই বরকতদের রক্তে সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার রাজপথ। তবু বাংলার দামাল ছেলেরা ভয়ে পিছপা হয়নি। অধিকার আদায়ে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায় লিখেছেন, স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?/ভয় কি বন্ধু/আমরা এখনো চারকোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো! এই বাংলায় জন্ম নিয়ে বাংলায় কথা বলে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করা মহাপাপ। বিশে^র দরবারে বাংলা আজ প্রতিষ্ঠিত ভাষা। যুগে যুগে অধিকাংশ লেখক কবিই মাতৃভাষার গুণগান করেছেন। তাদের সাহিত্যে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ১৮৫৭ সালে জন্ম নেওয়া কবি কায়কোবাদের কবিতায়ও সেই প্রমাণই পাওয়া যায়। তার ‘বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা’ কবিতায় লিখেছেন’ বাংলা আমার মাতৃভাষা/বাংলা আমার জন্মভূমি/গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে বয়ে/যাহার চরণ চুমি। প্রথম ‘মা’ ডাক যে শব্দ দিয়ে শুরু করি সে তো এই বাংলা ভাষাই। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে যখন সমবেত কণ্ঠে গেয়ে উঠি- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি (আবদুল গাফফার চৌধুরী) তখন মনে অজান্তেই এই মাতৃরুপ পরম সুধা আমদের হৃদয়ে প্রশান্তি আনে। বাংলা ভাষা নিয়ে আরও বহু কবিতা এবং সাহিত্যের অন্যান্য শাখা সমৃদ্ধ হবে। শুধু এই ভাষার প্রতি থাকতে হবে গভীর মমত্ববোধ যেমন আমাদের মায়ের প্রতি রয়েছে।
×