ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নেই কোন ভোগান্তি- আছে স্বস্তি

প্রকাশিত: ২২:২০, ১৬ জানুয়ারি ২০২২

নেই কোন ভোগান্তি- আছে স্বস্তি

আজাদ সুলায়মান ॥ যাত্রীদের নজর কেড়েছে ঢাকা নগর পরিবহন। নেই কোন ভোগান্তি- আছে স্বস্তি। ছোটখাটো কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়া নেই কোন বড় অভিযোগ। আপাতত ৫০টি বাস দিয়েই চলা ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামের এই সার্ভিসটিতে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত প্রতিদিনই বাড়ছে যাত্রীদের চাপ। প্রথম প্রথম এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও এখন যাত্রীরা বলছেন, অন্যদের তুলনায় এটা বেশ স্বস্তিদায়ক। এটাকে আরও ভাল করার সুযোগ আছে। ঢাকা নগর পরিবহনের অন্তত ২০ জন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এমনই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া। যাত্রীদের ভাষ্যমতে- ‘এই বাসে সব থেকে বেশি যে ব্যাপারটি ভাল লাগে সেটা হলো টিকেট ব্যবস্থা ও ভাড়া। অন্য বাসের তুলনায় এই বাসের ভাড়া যথেষ্ট কম। টিকেট সিস্টেম থাকায় বাসে ওঠার সময় হুড়াহুড়ি নেই। টিকেট কেটে লাইন ধরে সবাই সুশৃঙ্খলভাবে বাসে ওঠার সুযোগ পান। ভিড় মোটামুটি কম। সকালে অফিসে যাবার সময় কিছুটা ভিড় থাকে, দুপুরে কমে যায়, বিকেলে ফের চাপটা বাড়ে। তবে পাঁচ মিনিট পরপর বাস আসায় সঙ্কট কেটে যায়। এখানে ভাড়া নিয়ে নেই কোন তর্কাতর্কি। যাত্রীরাও সবাই চুপচাপ ওঠে, শান্ত হয়ে বসে থাকে। নতুন এই সার্ভিসটির ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে নানা ধরনের মতামত প্রকাশ করেন। বিশেষ করে নতুন বাস না দিয়ে পুরনো বাস দিয়ে এ সেবা চালু করা নিয়েও সমালোচনা চলে।’ যাত্রীদের প্রশংসার পাশাপাশি বাস মালিক শ্রমিকদের মুখেও ছিল বেশ আশার বাণী। এক মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঢাকা নগর পরিবহনের সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় হলো- এখানে নেই কোন চাঁদাবাজি। আগে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিকে দৈনিক চাঁদা দিতে হতো প্রতিটি বাসকেই। চাঁদা ছাড়া বাস চালানো সম্ভব ছিল না। এখন সেটা লাগে না। সরকারী ব্যবস্থাপনায় চলায় ঢাকা নগর পরিবহনের মালিকরা খুশি। এভাবে যদি একে একে গোটা রাজধানীতে ঢাকা নগর পরিবহনের সার্ভিস ছড়িয়ে দেয়া হয়-তাহলে পরিবহন সেক্টরের মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য চিরদিনের জন্য অবসান ঘটবে। এ বিষয়ে হামিদ নামের একজন শ্রমিক বলেন- চাঁদামুক্ত পরিবহন প্রতিষ্ঠা করা গেলে সড়কে ফিরে আসবে শৃঙ্খলা, শান্তি ও নিরাপত্তা। ঢাকা সড়কের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ঢাকার দুই মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আর আতিকুল ইসলাম যে এত বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন এটা আমাদের কাছেই স্বপ্নের মতো লাগছে। ঢাকা নগর পরিবহনের সেবা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে- তাতে বলা যায় মোটামুটি ভালই। আসলে এটা একটা নতুন সার্ভিস। এই সার্ভিসটাকে অবশ্যই আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। যদিও আমার মনে নানা শঙ্কা জাগে সার্ভিসটি শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কিনা। কেননা এর আগে রাজধানীতে চক্রাকার বাস সার্ভিসসহ অন্যান্য সার্ভিস চালু হয়েছিল। কিন্তু পরিবহন সেক্টরের চিহ্নিত মাফিয়াদের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত তা টিকতে পারেনি। ভয়টা এখানেই। তারপরও আমি আশাবাদী এখন ঢাকার দুই মেয়রের সততা, আন্তরিকতা, দৃঢ়তা ও হার না মানার মতো কঠোর মনোবলের কারণে এবার হয়তো চাঁদাবাজরা সুবিধা করতে পারবে না। সম্প্রতি ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত কয়েকটি স্টপেজ সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়- প্রথমদিন কিছুটা ব্যত্যয় ঘটলেও এখন তা বেশ সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা হচ্ছে। বিশেষ করে যাত্রী কম থাকলেও আলাদা কোন চাপ নেই এই বাসের চালক এবং সহকারীদের মধ্যে। নুসরাত জাহান শতাব্দী নামের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলেন, আমি প্রেসক্লাব থেকে কাঁচপুরের যাত্রী ছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম ভাড়া কত নেবে। স্টুডেন্টস ভাড়া নেয় কিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। কিন্তু স্টুডেন্ট পরিচয় দিতেই হাফ ভাড়াতেই টিকেট মিলল। টিকেটের সঙ্গেও উল্লেখ ছিল-এই টিকেটটি শিক্ষার্থীর জন্য। এটা ভাল লেগেছে আমার। বিশেষ করে সব শিক্ষার্থীর জন্যই এটি সুবিধাজনক। শুধু পরিচয়পত্র দেখালেই হলো। এভাবে যদি সব বাসেই পাওয়া যেত-কতই না সুবিধা হতো। ঢাকা নগর পরিবহন সার্ভিস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে নানা মতামত। তামান্না আলম নামে একজন ফেসবুকে ট্রাফিক এলার্ট গ্রুপে লিখেছেন- নগর পরিবহনের বাসে যাতায়াত করার চেষ্টা করছি। সার্ভিস সন্তোষজনক। আগের চেয়ে এখন সময়টা কম লাগছে। কিন্তু বাসে যাত্রী কম। সবারই কম বেশি উচিত এই বাসে ওঠা। তাহলে আমাদের জন্যই ভাল হবে। শর্মিষ্টা নামের একজন যাত্রী বলেন, ভালই তো। খারাপ তো কিছু দেখছি না। আগে আমি মোহাম্মদপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত রজনীগন্ধা বা মালঞ্চ বাসে যাতায়াত করতাম। এই বাস দেখে ভাবলাম নতুন সার্ভিস, ভালই হতে পারে। এখন দেখছি তাই। টিকেট কাউন্টারের সাজ দেখে মনে হলো ভাড়া বেশি হতে পারে। কিন্তু দেখলাম মোহাম্মদপুর থেকে গুলিস্তান অন্যান্য বাসের মতো ২০ টাকাই ভাড়া। চলতি পথে দেখলাম এই বাসের আগে ছেড়ে আসা রজনীগন্ধা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কোন ধাক্কাধাক্কির ঝামেলা নেই, আরামদায়ক সার্ভিস। ইরতিজা মাহমুদ নামের এক চাকরিজীবী বলেন, শেষ ভাল যার সব ভাল তার। কতদিন এটা টিকতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়। নগর পরিবহনের এক বাসের চালক বলেন, সবাইকে খুশি মনে হচ্ছে। যাত্রীরা ভাল থাকলে আমাদেরও ভাল লাগে। তবে যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা সিস্টেমের মধ্যে এলে যাত্রী হয়রানি বন্ধ হবে। এখন যাত্রী কমবেশি মিলিয়ে পাচ্ছি। যদিও কখনও যাত্রীতে বাস পরিপূর্ণ হয়নি। সামনে হয়তো বাড়বে। এখনও অনেকে এই বাস সম্পর্কে জানে না। তাদের জানাতে হবে। প্রচার করতে হবে। এ সার্ভিসের সার্বিক পরিস্থিতি কেমন চলছে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ আবু নাছের বলেন, মানুষ অনেক খুশি। যদিও কিছুটা বিচ্যুতি আছে। যেমন যাত্রী ছাউনির কিছুটা স্বল্পতা। এখনও মাঝে মাঝে অন্য সার্ভিসের বাস এসে এখানে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, স্টপেজে অবৈধ পার্র্কিং করা চেষ্টা চালায়। এগুলোও থাকবে না। আগামী ১২ জানুয়ারি থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হবে। তখন এগুলোও থাকবে না। আসলে প্রত্যেকটা নতুন ব্যবস্থাপনায় মানুষ একটু সংশয় প্রকাশ করেন। সেই জায়গা থেকে আমাদের গণমাধ্যমগুলো যদি বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে এবং বেশি বেশি মানুষের সামনে নিয়ে আসে তাহলে এই নতুন ব্যবস্থাপনাকে একটি মজবুত ভিত্তি দেয়া সম্ভব হবে। এটা পাইলট প্রকল্প। এর সফলতা ও ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করবে ঢাকা সিটির নগর পরিবহনের ভাগ্য। এটা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) আওতাধীন। এতে দুই সিটির দুই মেয়রও সদস্য। আছেন অন্যান্য স্টেকহোল্ডারও আছেন। বলা যায়, এটা উচ্চপর্যায়ের একটা শক্তিশালী কমিটি। কিন্তু এটা সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করে আমাদের ডিটিসিএ। যদি এটা সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন থাকত, তাহলে আমাদের পার্সোনালি ফোর্সটা বাড়িয়ে দিতাম। উল্লেখ্য, গত ২৬ ডিসেম্বর চালু হওয়া ঢাকা নগর পরিবহনের ৫০টি বাস চলাচল করছে। প্রতিটির গায়ে ঢাকা নগর পরিবহন লেখা রয়েছে। দুমাসের মধ্যে বহরে আরও ৫০টি বাস যুক্ত করা হবে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বাসগুলো যাত্রী পরিবহন করছে। সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ‘পিক টাইম’ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময় ৫ থেকে ৭ মিনিট পর পর যাত্রীছাউনিতে বাস এসে দাঁড়াতে দেখা গেছে। অন্য সময় আসে প্রতি ১০ মিনিট পর পর। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রীরা ওঠানামা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বহুল প্রতীক্ষিত এই বাস রুট র্যা শনালাইজেশনের আওতায় ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত রুটে একক কোম্পানির অধীনে বাস চলাচল করছে। ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রুটে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর ডিপো থেকে বাস ছেড়ে বসিলা, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শঙ্কর, জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, প্রেস ক্লাব, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, নটর ডেম কলেজ, ইত্তেফাক মোড়, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, চিটাগং রোড হয়ে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত যাচ্ছে। দীর্ঘ এ রুটে যে কোন গন্তব্যের জন্য ন্যূনতম ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা-আর সর্বোচ্চ ভাড়া ৫৯ টাকা। কিলোমিটার প্রতি ভাড়া পড়ছে ২ টাকা ২০ পয়সা করে। বহুল আলোচিত আজকের এই রুটের স্বপ্ন দেখেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনিই আজকের এই ঢাকা নগর পরিবহনের পথ দেখিয়েছিলেন। তার অকাল প্রয়াণেও থেমে থাকেনি উদ্যোগ। বরং দ্রুততার সঙ্গে ঢাকার দুই পরাক্রমশালী মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে কঠোর মনোবল নিয়েই প্রতিটি বৈঠকে নিজেদের আপোসহীনতা সম্পর্কে সরব থাকেন। কারণ এই সার্ভিসটি যাতে চালু না হতে পারে সেজন্য পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজ মাফিয়ারা সোচ্চার ছিল বরাবরই। তাদের নানা ওজর আপত্তি সব মোকাবেলা করেই দুই মেয়র শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির আলোর দিশা দেখান। শেষ পর্যন্ত গত ২৬ ডিসেম্বর এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বর্তমান দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস। তারা আশ্বস্ত করেন, এটা সবে শুরু। পর্যায়ক্রমে ঢাকার সব রুটেই এভাবেই বাস রেশনাইলেজশনের মাধ্যমে পরিবহন চালু করা হবে। নগরবাসীর স্বার্থে যতরকম বাধাই আসুক, তা মোকাবেলা করা হবেই। জানতে চাইলে ঢাকা পরিবহন সমন্ব কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, যাত্রীরাও হ্যাপি, আমরাও হ্যাপি। নতুন সার্ভিস নিয়ে কিছু কথা থাকতেই পারে। তারপরও বলব ভালই চলছে। আগামী ১৭ জানুয়ারি একটা বৈঠকে আরও এ ধরনের নতুন বাস সার্ভিস চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
×