ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে রংপুরে রোকেয়া দিবস পালিত অকার্যকর রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র

প্রকাশিত: ২০:১৮, ৯ ডিসেম্বর ২০২১

নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে রংপুরে রোকেয়া দিবস পালিত অকার্যকর রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ ৯ ডিসেম্বর নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম ও মৃত্যু দিবস নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় রংপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এছাড়াও সীমিত পরিসরে রংপুর জেলা ও মিঠাপুকুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করা হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় আলোচনা সভা, দুপুরে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ রোধে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। দুপুর দেড়টায় মিলাদ মাহফিল ও বিকেল সাড়ে ৩টায় অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মিঠাপুকুর পায়রাবন্দে আয়োজিত দিবসটির আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রংপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান। জেলা প্রশাসক আসিব আহসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন, রংপুর জেলার পুলিশ সুপার মো. ফেরদৌস আলী চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু। আলোচক ছিলেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. সরিফা সালোয়া ডিনা, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ্ আলম, বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মনোয়ারা বেগম প্রমূখ। স্বাগত বক্তব্য দেন, মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জোহরা। অন্যদিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টায় কেন্দ্রীয় ক্যাফেটোরিয়া চত্বরে রোকেয়ার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বিকেল সাড়ে ৩টায় ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. হাসিবুর রশীদ। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. সরিফা সালোয়া ডিনা। বেগম রোকেয়া জন্মস্থান পায়রাবন্দএ গিয়ে দেখা যায়, তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ভিটেমাটি অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে। তার জীবনকর্ম নিয়ে গবেষণায় চালু থাকা স্মৃতিকেন্দ্রের তেমন কোন কার্যক্রম নেই। নই পর্যাপ্ত উপকরণ। কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার উদ্যোগটিও লালফিতায় বন্দী। ৯ ডিসেম্বর একই দিন এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা আর নানা আশ্বাসে কেটে যায়। রোকেয়ার এলাবাসী জানে না তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হবে কি-না। দিবসটি নিয়ে নানা আয়োজন থাকলেও রোকেয়ার জন্মস্থানে তার ভক্ত-অনুরাগীদের মন ভালো নেই। এ বছরও রোকেয়ার কবরে ফুল দিতে পারছে না রংপুরবাসী। বেগম রোকেয়া উপমহাদেশের নারীসমাজকে কুসংস্কারের দেয়াল ছেদ করেছিলেন। গৃহবন্দী নারীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আলোর মশাল। সেই মহীয়সী নারীর স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান আজও পড়ে আছে অবহেলায়। উদ্যোগের অভাবে এখানে রোকেয়াচর্চা ও পর্যটন কেন্দ্রের দ্বারও রুদ্ধ। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাকিস্তান থেকে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মরদেহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে আনার পর রংপুরের আলোকিত ব্যক্তি রোকেয়ার মরদেহটিও পায়রাবন্দে এনে সমাহিত করার জন্য জোরালো দাবি উঠেছিল। ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলার আলোচনা সভায় তার ভাতিজি রনজিনা সাবের দাবি তোলেন বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে ফিরিয়ে আনার। রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক দাবিটির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পেরিয়ে গেল এক দশক। এ ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন। পরে প্রতিশ্রুত এই ঘোষণার বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে একাধিক নারী সংগঠন সভা, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেও কিছুই হয়নি। ২০ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি। আইনি জটিলতা কাটলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে এটি পড়ে আছে অবহেলায়। অথচ নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতিচর্চা এবং স্থানীয় যুবাদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে ২০০১ সালে স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। ৩ একর ১৫ শতক জমির ওপর নির্মিত কেন্দ্রটি দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় নষ্ট হচ্ছে আসবাবসহ বিভিন্ন উপকরণ। স্মৃতিকেন্দ্রটিতে একটি আধুনিক মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, পাঠাগার, সেলাই মেশিনসহ একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। আরও আছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস, কেন্দ্র চত্বরে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য ও উপপরিচালকসহ কর্মচারীদের আবাসনব্যবস্থা। জনবল-সংকট বিভিন্ন কারণে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি বন্ধ। কাজে আসছে না মিলনায়তন। পাঠাগার থাকলেও নেই রোকেয়ার জীবনদর্শন জানানোর মতো পর্যাপ্ত বইপুস্তক। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালে তিনি এটি উদ্বোধন করেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথমে কেন্দ্রটির দায়িত্বভার নিলেও তিন বছর পর দায়িত্ব পায় এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলা একাডেমি। ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে বাংলা একাডেমির অধীনে স্মৃতিকেন্দ্রটি হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। তারপর বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত এই কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালুর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পাঠাগার আর কিছু শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংগীত ও চিত্রাঙ্কন চর্চা চালু রয়েছে। তবে বেশির ভাগ পাঠকই হতাশ পাঠাগারের বই-সংকটের করুণ দশায়। নানা বিষয়ে পায়রাবন্দ এলাকার মানুষের মনে হতাশা ও ক্ষোভ। ১১ বছর আগে রংপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম এনামুল হক কলকাতা থেকে বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ পায়রাবন্দে তার জন্মস্থানে আনার প্রতিশ্রুত দেন। কিন্তু তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। শুধু তা-ই নয়, বেগম রোকেয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিকেন্দ্রটিও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেই মহীয়সী এ নারীর কোনো ভাস্কর্য, তার নামে ছাত্রীনিবাস বা গবেষণাকেন্দ্র। রোকেয়ার আদর্শে সমাজসংস্কারে মেয়েরা এগিয়ে গেলেও অবহেলিত রয়েছে গেছে তার জন্মস্থান পায়রাবন্দ। রোকেয়ার বাস্তভিটার পাশেই গড়ে ওঠা পায়রাবন্দ সরকারি বেগম রোকেয়া স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, শুধু ৯ ডিসেম্বর এলেই আমাদের মনে পড়ে বেগম রোকেয়া নামে এখানে কেউ ছিলেন। কিন্তু দিবসটি পার হলেই আমরা তাকে মোটেও স্মরণ করি না। আমাদের ইচ্ছা আমরা রোকেয়ার কবরে ফুল দেব। কিন্তু ভারত থেকে তার দেহাবশেষ আনার কোনো উদ্যোগ নেই। দিন দিন বেগম রোকেয়ার ভিটেমাটি ও সম্পত্তিও বেহাত হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী প্রজন্মের মাঝে রোকেয়ার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল। তিনি বলেন, বিবিসির জরিপে বিশ্বসেরা ২০ নারীর তালিকায় বেগম রোকেয়ার স্থান ৬ নম্বরে। অথচ তার দেহাবশেষ দেশে আনতে বছরের পর বছর গুনতে হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। উদ্যোগ এখন ফাইলবন্দি। তিনি আরো বলেন, বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দেশে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ রোকেয়ার নামে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু রোকেয়ার দর্শন ও চেতনাকে মনের মধ্যে লালন করা হচ্ছে না। স্মৃতিকেন্দ্রের পাঠাগারে রোকেয়া সম্পর্কিত দুটো বইপুস্তকও নেই। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও কিন্তু রোকেয়া আবশ্যিক নয়। সেখানে রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা, পড়াশোনা হয় না। যার নামে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্মৃতিস্মরণে ভাস্কর্যও নেই। রোকেয়ার বাস্তভিটাকে প্রতœসম্পদে পরিণত করতে কোনো উদ্যোগ নেই। আমার কাছে মনে হয় এখন যা হচ্ছে, তা রোকেয়াকে ধারণ করে নয়, বরং এটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। বেগম রোকেয়ার ভাতিজি রনজিনা সাবের বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই সম্ভব। আমাদের এই সামান্য দাবিটা সরকার পূরণ করতে পারছে না? অন্যদের মরদেহ যদি আনা যায়, তবে কেন বেগম রোকেয়ার মরদেহ আনা হচ্ছে না? আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে? আমরা রোকেয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। এ ব্যাপারে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উপপরিচালক আব্দুল্যাহ আল-ফারুক বলেন, অচিরেই স্মৃতিকেন্দ্রে বন্ধ থাকা বৃত্তিমূলক সেলাই প্রশিক্ষণ চালু করাসহ নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেগম রোকেয়ার জীবন, সাহিত্য, কর্ম-দর্শন ব্যাপক প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি থেকে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই স্মৃতিকেন্দ্রটি আরও আধুনিক করা হবে। গবেষকদের জন্য বিশেষায়িত একটি গবেষণামূলক পাঠাগার ও ডরমেটরি করা হবে। এতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত শিক্ষার্থী, দর্শনার্থী, গবেষক ও পর্যটকরা উপকৃত হবেন। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি আবারো প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, বেগম রোকেয়া শুধু মিঠাপুকুর বা পায়রাবন্দের নয়, তিনি সারা বাংলাদেশের। তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন। তার যে বাস্তভিটা এবং সম্পত্তি তা নিয়ে দুটি মামলা চলমান রয়েছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে আদালতে একটা জবাব দিয়ে দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি সেগুলো মনিটর করার। একই সঙ্গে ভারতের সোদপুরে থাকা বেগম রোকেয়ার কবরটি বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও কথাবার্তা হচ্ছে। এটি দুটি রাষ্ট্রের সরকার পক্ষের কূটনৈতিক বিষয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সাল থেকে পায়রাবন্দবাসী বেগম রোকেয়ার স্মরণে রোকেয়া দিবস পালন করে আসছেন। সরকারিভাবে ১৯৯৪ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় বেশ ঘটা করেই দিবসটি পালন করা হয়। সারাদেশে দিনটি উদযাপন করা হয় রোকেয়া দিবস হিসেবে।
×