ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইপিআর জওয়ানদের যশোর পাঠানো

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

ইপিআর জওয়ানদের যশোর পাঠানো

(গতকালের পর) ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। যশোর সেনানিবাসে শুরু করে বাঙালী অফিসারদের হত্যাযজ্ঞ। এক পর্যায়ে বাঙালী অফিসার ও সৈনিকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সংঘর্ষ তখন সেনানিবাসের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। সাতক্ষীরা সীমান্তের ইপিআর ক্যাম্পগুলো থেকে নেতৃস্থানীয় জওয়ানরা আমাদের কাছে আসেন। সাতক্ষীরা শহরে পাকপোলের মোড়ে পরিচ্ছদ বস্ত্র বিতানের পাশে ছিল কুড়ন ময়রার রেস্টুরেন্ট। আমরা ওখানে আড্ডা দিতাম। ওখানে তৎকালীন ইপিআরের সীমান্ত অঞ্চলে পোস্টিংয়ে থাকা কয়েক হাবিলদার ও সুবেদার আসতেন। আমাদের সঙ্গে চা খেতেন। তখন থেকেই ওনাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। সাতক্ষীরায় ইপিআর সদর দফতর বর্তমান স্টেডিয়াম সংলগ্ন ছিল। আমরা একই মাঠে খেলাধুলা করতাম। আমাদের বাড়ি ইপিআর সদরের পাশে। ইপিআরে কর্মরত অধিকাংশকেই চিনতাম। তারাও আমাকে জানতেন। তারা এসে আমাদের বললেন, যশোর সেনানিবাস এলাকায় যুদ্ধ চলছে। আমাদের বাঙালী ভাইয়েরা যুদ্ধে পাকিস্তানীদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকতে পারছে না। সেখানে এখনই বাঙালীদের লোকবল (যোদ্ধা) বাড়ানো প্রয়োজন। আমরা এখনই ওই যুদ্ধে যাব, আপনারা আমাদের সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করুন। আমরা ওনাদের আশ্বস্ত করলাম। আপনারা ক্যাম্পে ফিরে যান। আমরা যত দ্রুত সম্ভব পরিবহনের ব্যবস্থা করে আপনাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি। আমরা চিন্তা করলাম কলারোয়া থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত এতগুলো সীমান্ত চৌকি থেকে ইপিআর ভাইদের আনতে অনেক পরিবহন প্রয়োজন। কোন কোন এলাকায় চলাচল নদীপথে। তাদের অগ্রবর্তী ক্যাম্পে আসতে বলতে হবে, যাতে তাদের বাস বা ট্রাকে করে সাতক্ষীরায় আনা যায়। ইপিআর ভাইদের আমরা সেভাবে বলে রাখলাম। এরপর আমরা (হাবলু, মাসুদ, এনামুল, তারিকুল, নাজমুলসহ অন্যরা) নেমে পড়লাম গাড়ি সংগ্রহের কাজে। রিকুজিশনের মাধ্যমে গাড়ি সংগ্রহ করতে আমরা সাতক্ষীরা থানাতে যাই। সেখানে তখন ওসি ছিলেন আবদুল হাকিম। তিনি আমাদের ফিরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা ছেলে মানুষ, মাথা গরম। এসব কাজ এভাবে করা ঠিক নয়। এনএসএফ নেতা হাবিবুর ওই সময়ে আওয়ামী লীগের সংগ্রাম কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। আমরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলাম। পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেদের চেষ্টায় বাস ও ট্রাক সংগ্রহ করতে হবে। সে চেষ্টায় নেমে পড়লাম। প্রথমেই টার্গেট করলাম এবি খান। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত ঠিকাদার। সম্পর্কে তিনি আমার নানা হতেন। তার আরও একটি পরিচয় তিনি বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়াত ডাঃ এম আর খানের পিতা। ’৬৯-এর আন্দোলনের সময় থেকে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় বিশেষ এক কারণে। একদিন সকালে তাঁর ড্রাইভার আমাদের বাসায় এসে আমাকে বলল, আপনার দাদু আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। আমি ভয়ে ভয়ে দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি বললেন, দাদু আমি জানতাম না তুমি ছাত্রলীগের সাতক্ষীরা মহকুমার সাধারণ সম্পাদক। আজই এন্তাজের কাছে জানলাম। অনেকে চাঁদার জন্য আসে, ছাত্রলীগের কথা বলে চাঁদা চায়। তারা কেউ ছাত্রলীগের কোন কর্মকর্তা নয়। তাই তোমাকে ডাকা। তোমাদের যদি কিছু প্রয়োজন হয় আমাকে জানিও। আমি চেষ্টা করব সহায়তা করার। তুমি ছাড়া অন্য কেউ যেন না আসে। এরপর থেকে দলের প্রয়োজনে সাংগঠনিক কাজে এবি খান সাহেবের কাছ থেকে মাঝে-মধ্যে আর্থিক সহায়তা নেয়া হয়। ’৭০-এর নির্বাচনের আগে আমরা উদ্যোগ নিলাম বর্তমান শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে শহীদ মিনার গড়ার। অনেকের কাছ থেকে ইট, সিমেন্ট ও রড নেয়া হয়। এবি খান সাহেবও সহায়তা করেছিলেন। ইপিআরদের পরিবহনে তাঁর কাছ সাহায্য চাই। প্রথম ট্রাকটি পেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে। এরপর নেই পলাশপোলের পৌর কমিশনার কেনা চৌধুরীর একটি ট্রাক। হাবলুর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল সোবহান খানের সঙ্গে। উনি পরিবহন ব্যবসায়ী ছিলেন। ওনার ট্রাকটিও নেয়া হলো। এভাবেই বেশ কয়েকটি ট্রাক ও বাস সংগৃহীত হলো। এবার সকল ইপিআর সদস্যকে সাতক্ষীরা সদরে আনার পালা। এই কাজটি আমরাই করি। ট্রাক ও বাস সংগ্রহ করে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ট্রাক ও বাসের সংখ্যা আজ আর মনে নেই। তবে এটা মনে আছে ইপিআর ক্যাম্পে যেতে প্রত্যেক গাড়িতে দু’জন করে কর্মী দেয়া হয়। ইপিআর ক্যাম্পগুলোতে বাঙালী জওয়ানদের পাশাপাশি ছিল অবাঙালী সদস্য। তারা ছিল মূলত সুবেদার, সুবেদার মেজর, হাবিলদার ইত্যাদি পদে। বাঙালী সৈনিকরা যুদ্ধে যোগ দেবে। সেই প্রস্তুতি নিয়ে তারা রওনা হচ্ছে। ক্যাম্পে ক্যাম্পে অবাঙালীরা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই শত্রুদের পরাস্ত করেই বাঙালী সৈনিকদের যুদ্ধের ময়দানে যেতে হয়। ক্যাম্পগুলোতে এদের প্রতিহত করা হয়। কোথাও হত্যা করা হয় আবার কোথায় আটক করে পরে জেলে দেয়া হয়। যতদূর মনে পড়ে হাবলু গিয়েছিল ভোমরা ক্যাম্পে, মাসুদ বৈকারী ক্যাম্পে। আমি নিজে গেছিলাম ট্রাক নিয়ে দেবহাটা। পথে পারুলিয়া থেকে আমাদের কর্মী আতিয়ারকে (গদাই) সঙ্গে নেই। আমরা যখন পৌঁছাই তখন বিকেল হয়ে গেছে। তখন দেবহাটা থানা প্রাঙ্গণে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ইপিআর সৈনিকরা গরুর গাড়িতে করে এসে জড়ো হয়। তখন সীমান্ত এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা দুর্গম ছিল। গরুর গাড়ি ও নৌকাই ছিল বাহন। আমরা দেবহাটার পাশে একটা ক্যাম্প থেকে ইপিআরদের ট্রাকে তুলে নেই। ট্রাকে একজন অবাঙালী সুবেদার মেজর ছিল। তাকে দেখে আমি চিনলাম। পাঞ্জাবি এই সুবেদার মেজরকে চিনি দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের বাড়ি ছিল ইপিআর ক্যাম্পের পাশে। ইপিআর জওয়ান ও তাদের কর্মকর্তাদের অনেককেই চিনতাম। সেভাবেই তার সঙ্গে পরিচয়। হাল্কা-পাতলা গড়ন, চোখ দুটো ছিল লাল টকটকে। ইপিআর ক্যাম্পের সামনের পুল পার হতে অনেক সময় ভয়ও পেতাম এই সুবেদার মেজরের জন্য। তার চেহারায় ফুটে উঠত একটা হিংস্র তার ছাপ। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরুর আগে এই পাঞ্জাবিকে হাতে পেয়ে আমাদের মধ্যে সেকি উত্তেজনা। ট্রাকে ওঠার সময় ইপিআরের এক জওয়ান তার কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে সামনে ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসায়। সৈনিকরা আমাদের বলেন, ‘আমাদের বস, আমরা গায়ে হাত দেব না, আপনারা ওকে ধরে নিয়ে যাবেন থানায়।’ গদাইকে বলি, থানা প্রাঙ্গণে ট্রাক পৌঁছলে তুমি ওনাকে ধরে নিয়ে যাবে। উনি নিরস্ত্র থাকায় কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সুবেদার মেজর ছিল অন্তত ৬ ফুট লম্বা। গদাইও ছিল দীর্ঘদেহী। গাড়ি থেকে নেমে গদাই তার হাত ধরে বলে, ‘থানায় চলেন।’ এক ঝটকায় হাত ছড়িয়ে নেয় সুবেদার মেজর। আমি তখন লাফ দিয়ে কাছে গিয়ে তার মাজা জাপটে ধরে ঝুলে পড়ি। দু’জনে মিলে টেনে-হিঁচড়ে তাকে থানায় ঢোকাই। দেবহাটা থানা প্রাঙ্গণ তখন লোকে লোকারণ্য। এভাবে পার্শ্ববর্তী ক্যাম্প থেকে আরও কয়েকজন খানসেনাকে এখানে আটকে রাখা হয়েছিল। পরে এদের ভারতের জেলে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে সীমান্ত অঞ্চল থেকে ইপিআর সদস্যদের বাস/ট্রাক করে আমরা সাতক্ষীরা শহরে নিয়ে আসি। সাতক্ষীরা শহরে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর অনেককেই তৎপর হতে দেখা যায়। আগে যারা মূলত নিষ্ক্রিয় ছিল। পরে ইপিআর সদস্যদের যশোর রণাঙ্গন অভিমুখে পাঠানো হয়। তখন দেখেছি সাতক্ষীরা-যশোর রাস্তার দু’ধারে মানুষ ডাব বা ফলমূল দিচ্ছে এসব ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাকে। (চলবে) লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ
×