হাসান নাসির, সাজেক ঘুরে এসে
সাজেক। সুউচ্চ পাহাড়ে মেঘের পরশ। শৃঙ্গে আরোহণমাত্রই মায়াবি আলিঙ্গন। পূর্বদিকে তাকালে ভারতের মিজোরাম। দিগন্তজুড়ে বিস্তীর্ণ পর্বতমালা। সবচেয়ে উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে যেদিকে চোখ যায়, শুধুই সবুজ আর সবুজ। বুকভরা নিশ্বাস, মনে প্রশান্তি। তাই তো প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছে অসংখ্য পর্যটক।
‘সাজেক’ নামটি একযুগ আগেও তেমন শোনেনি এদেশের মানুষ। এত অল্প সময়ের মধ্যে একটি স্থান পর্যটকদের এভাবে টানতে পারে, তা কল্পনাতীত। কেউ বলেন বাংলার দার্জিলিং, কেউ বলেন বাংলার শিলং। আবার অনেকের মতে, সঠিক পরিকল্পনায় বিন্যাসিত হলে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাবে এই সাজেক।
বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর অন্যতম সাজেক উপত্যকা। পাহাড়ী পথের ধকল কিছুটা সইতে হয়। তবে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় মোহনীয় সৌন্দর্য। উদাসমনে মানুষ সাধারণত ওপরের দিকেই তাকায়। কিন্তু এখানে দৃষ্টি থাকে অবনত। কারণ, আকাশ নেমে এসেছে নিচে, যেন মেঘের ভেলায় চড়ার অনন্য এক অনুভূতি। বর্ষায় ঘনকালো ভেজা মেঘের আচ্ছাদন, আর শীতে কুয়াশার চাদর দুই-ই মনোমুগ্ধকর। প্রকৃতি কি হতে পারে এতটা সুন্দর!
‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’- রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার ক’টা লাইন অনেকে পড়েছেন। সাজেক ভ্যালি দেখলে মনে হবে আহা! এমন সৌন্দর্য নিজ দেশেই! অথচ কতই না পড়েছিল অগোচরে। এই সাজেক আবিষ্কার হতেই লেগে গেল এতটা বছর! পর্যটকদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য এখন সাজেক। গিয়েছেন অনেকে, আর যারা যাননি তাদের পরিকল্পনা নিশ্চয়ই রয়েছে এই সুউচ্চ চূড়া।
অনেক উচ্চতায় এই মেঘ পাহাড়ের মেলবন্ধন। রুইলুই পাড়া এবং কংলাক নিয়ে সাজেক। এর মধ্যে রুইলুই পাড়ার উচ্চতা ১৭২০ ফুট। আর কংলাকের উচ্চতা ১৮০০ ফুট। রাঙ্গামাটি জেলার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হওয়ায় এর আরেক নাম রাঙ্গামাটির ছাদ। সেখানে বসবাস লুসাই, ত্রিপুরা, পাংখোরা নৃগোষ্ঠীর। দীর্ঘ পথে যেতে পড়বে বিভিন্ন পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জীবনধারা। একের পর এক পাহাড় অতিক্রম করার সময় আবেগপ্রবণ হবেন নিশ্চয়ই। সর্বশেষ চূড়ায় আরোহণকালে পাওয়া যায় অনেকটা উড়োজাহাজে চড়ার অনুভব। কর্ণকুহরে চাপ অনুভূত হবে। মনে হবে যেন ক্ষণিকের জন্য দু’কান বন্ধ হয়ে এসেছে। এবার অন্যরকম এক প্রশান্তির আমেজ।
যেভাবে যাবেন সাজেক ॥ সাজেকের অবস্থান রাঙ্গামাটি জেলায় হলেও যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। কারণ, সংযোগটা এ পথেই। খাগড়াছড়ি এলে একরাত থাকতে হবে। পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে দীঘিনালা পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে বাঘাইহাট। এ সময়ে সেনাবাহিনীর স্কট থাকে। যদি কোন কারণে এর মধ্যে পৌঁছানো না যায়, তবে অপেক্ষায় থাকতে হবে বিকেল তিনটা পর্যন্ত। তখন থাকে দ্বিতীয় স্কট। সকালে গিয়ে বিকেলেই ফেরা যায়। তবে ভালোভাবে সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে কাটাতে পারেন একটি রাত। কারণ ভোর এখানে বড়ই মোহনীয়। এ সৌন্দর্য না দেখলে সাজেক ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়।
ভোরের পূর্বাকাশে লালিমা ছড়িয়ে ওঠে আসে সূর্য। এরপর ক্ষণে ক্ষণে রং বদল করতে থাকে পাহাড়। যে পাহাড়গুলো ঢাকা পড়ে থাকে শীতের কুয়াশায়, সেগুলো দৃশ্যমান হয় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। প্রকৃতির এই রূপান্তর না দেখে কল্পনা করা কঠিন। আর সে জন্যই একটি বিকেলের পর একটি ভোর বড়ই প্রত্যাশিত।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যেতে হলে সেই সড়কে চলাচলকারী মাহিন্দ্র ফোর হুইল শক্তির গাড়িগুলোই উত্তম। পাহাড়ী পথে এগুলোই সবচেয়ে উপযোগী। একদিনে যাওয়া-আসার জন্য ভাড়া পড়বে সাড়ে ৮ হাজার টাকা। আর পরদিন নিয়ে আসার চুক্তি থাকলে তা হতে পারে সাড়ে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে দামাদামিতে কিছু কম-বেশি হতে পারে।
সাজেকে থাকার ব্যবস্থা ॥ সাজেক ভ্যালিতে থাকার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় অবশ্যই সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ‘সাজেক আর্মি রেস্ট হাউস’। সেখানে থাকতে চাইলে বেশ আগেই বুকিং দিতে হয়। এ ছাড়া অসংখ্য হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস গড়ে উঠেছে। নিবন্ধিত হোটেল রিসোর্ট ১৮৬টি হলেও ছোট-বড় সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৩শ’র কাছাকাছি বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। ভাড়া হোটেলের মানভেদে বিভিন্ন রকমের।
সাজেকে পানি সরবরাহে কোন কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। ফলে হোটেলগুলোকে পানির সঙ্কট মোকাবিলা করতে হয়। তবে একেবারে দুষ্প্রাপ্যও নয়। ট্যাঙ্কে করে অনেক দূর থেকে পানি বহন করে নিয়ে আসা হয় যানবাহনে। হোটেলগুলো সেই পানি কিনে নিয়ে ছাদের ট্যাঙ্কে জমা রাখে। দেড় হাজার লিটারের এক ট্যাঙ্ক পানির দাম পড়ে ১ হাজার টাকা। ফলে পানির ব্যবহারে এখানে মিতব্যয়ী হতে হয়। দূর দূরান্ত থেকে এই পানি সরবরাহের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকের জীবিকা। সমস্যার সমাধানের জন্য সেখানে পাহাড়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হওয়া উচিত, এমনই অভিমত অনেক পর্যটকের।
ভাগ্য বদলে গেছে একটি সড়কে ॥ সাজেক একদা ছিল দৃষ্টির আড়ালে। খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দুর্গম পাহাড়ে আরোহণ করা ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দৃষ্টিনন্দন একটি সড়ক বদলে দিয়েছে দৃশ্যপট। যে সাজেক ছিল অগোচরে, তা এখন দেশের জনপ্রিয় এক পর্যটন স্পট। সেখানে অনেকেই খুঁজে পেয়েছে জীবিকা। অথচ এই সড়ক নির্মাণের পথে ছিল অনেক প্রতিবন্ধকতা। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে এসেছিল প্রবল বাধা। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর চ্যালেঞ্জিং এই সড়ক নির্মাণের কাজটি শেষ করার পর সেই বাধা প্রদানকারীরাই বরং বেশি উপকৃত হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দোকানপাট ও নানা ধরনের পণ্যের পসরা। সেই বাধাদানকারীরাও স্বীকার করছেন, এতে তারা জীবিকার সন্ধান পেয়েছেনে।
‘সাজেক পেদা টিং টিং’ রেস্টুরেন্টের কমী উদয়ন তঞ্চঙ্গা জানান, এই সড়ক অনেকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। পর্যটক আসায় খাবার, হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বিক্রির জন্য অসংখ্য দোকান গড়ে উঠেছে। বেড়াতে আসা লোকজন তদের দোকানে খাওয়া-দাওয়া করেন। নামিদামি হোটেল রিসোর্টগুলোতে তারা খাবার সরবরাহ করা হয় তাদের রেস্টুরেন্ট থেকে। শীতকালে পর্যটক হয় সবচেয়ে বেশি। সাজেকে সেনাহিনীর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি থাকায় নিশ্চিত হয়েছে নিরাপত্তা। সেখানে কোন অপরাধ নেই জনিয়ে উদয়ন জানান, দিনরাত নির্ভয়ে পর্যটকরা চলাফেরা করতে পারছেন। নিরাপত্তার অভাবে কোন অঘটন ঘটেছে, এমন কোন অভিযোগ আজ পর্যন্ত কেউ করেনি। আবার নীরব চাঁদাবাজির কিছু অভিযোগও রয়েছে, যা চলে সাধারণত ব্যবসায়ীদের ওপর। তবে পর্যটকরা এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ, এমনই এক বাক্যে বলছেন প্রায় সকলেই।