ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন আজ

প্রকাশিত: ২১:৫৭, ২৩ অক্টোবর ২০২১

কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আধুনিক বাংলা কবিতার এক অনন্য কবি শামসুর রাহমান। কাব্য রচনায় সৃষ্টিশীলতা ও মননের দ্যুতিময় উপস্থাপনা তাকে দিয়েছে কবিতার বরপুত্রের উপাধি। ছন্দোময় ও শিল্পিত শব্দের প্রক্ষেপণে কবিতার চরণে চরণে বলেছেন দেশ, মাটি ও মানুষের কথা। পরাধীনতার শৃঙ্খল পেরিয়ে বাঙালীর স্বাধীনতার কথাও বলেছেন কবিতার ভাষায়। নাগরিক এই কবি আমৃত্যু স্বদেশ ও শেকড়ের প্রতি ছিলেন দায়বদ্ধ। পাশাপাশি সমকালীনতা ধারণ করে সারাজীবন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত সমাজের কথা বলেছেন কাব্যের ছন্দে। আজ ২৩ অক্টোবর শনিবার বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান এই কবির ৯৩তম জন্মদিন ও ৯২তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন কবি। শামসুর রাহমানের জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে রবিবার একক বক্তৃতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বক্তৃতা প্রদান করবেন বিশিষ্ট গবেষক ও কবি অধ্যাপক খালেদ হোসাইন। স্বাগত বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির সচিব এ. এইচ. এম. লোকমান। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর তিলোত্তমা শহর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মেছিলেন এই কবি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝের ৭৭ বছরের বর্ণময় জীবনের বড় অংশজুড়েই নিমগ্ন থেকেছেন কবিতা সৃজনের মোহ ও অনুরাগে। পুরনো ঢাকায় বেড়ে ওঠায় নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ উদ্ভাসিত হয়েছে এ নাগরিক কবিতার কবিতায়। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার পথে ধাবিত করায় তাঁর ভূমিকাটি একেবারেই স্বতন্ত্র। বিশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। ষাটের দশকে গোড়ার দিকেই কবি প্রতিভার বিচ্ছুরণে আলোকিত করেন সাহিত্যের ভুবন। সূচনাটা অস্তিত্ববাদী ইউরোপীয় আধুনিকতায় ধাবিত হলেও একটা সময়ে দেশজ সুর ও ঐতিহ্যকে কবিতায় ধারণ করেছেন নিবিড় মমতায়। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার বুননে। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন কবিতার সৃষ্টিশীলতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একইসঙ্গে অনুপ্রেরণাদায়ী ও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। ‘উনিশ শ’ ঊনপঞ্চাশ’ শিরোনামের কবিতা রচনার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে পদচিহ্ন আঁকেন কবিতার আঙিনায়। এটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। আর এই শুরুটা ছিল শিল্পবোধসম্পন্ন সংবেদী পাঠকের জন্য লেখা কবিতার সৃষ্টিসম্ভার। পত্রপত্রিকায় লেখা তাঁর চিত্রকল্পময় কবিতার সূত্রধরে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগেই এপার-বাংলার কবিতাপ্রেমীদের নজর কাড়েন শামসুর রাহমান। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। কবির নিমগ্ন অন্তর্গত বোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও ষাটের দশকে প্রকাশিত কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ ও আমি অনাহারী। অন্তর্মুখী স্বভাবের হলেও রাজনীতির দহন থেকে গা বাঁচিয়ে চলেননি এই কবি। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও পরবর্তী বাস্তবতায় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন কলমকে। রচনা করেছেন অজস্র অনবদ্য কবিতা। তাঁর রচিত বন্দিশিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ কাব্যগ্রন্থগুলোয় তীক্ষ ও প্রবলভাবে বিম্বিত হয়েছে গণমানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। সত্তরের নম্বেরের ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ অথবা তারও আগে বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, একাত্তরের পটভূমিতে তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, গেরিলা, কাক ইত্যাদি কবিতাগুলোয় উচ্চারিত হয়েছে স্বদেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ ও ইকারুসের আকাশ। যুদ্ধাপরাধীদের উত্থানে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়ে লিখেছেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’, ‘ফুঁসে ওঠা ফতোয়া’র মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা। গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু সৈনিক শহীদ নূর হোসেনকে উৎসর্গ করে রচনা করেছেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এভাবেই নিভৃতচারী ও রোমান্টিক কবি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সমকালের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কাব্যভাষ্যকার। একইসঙ্গে কবিতার জমিনে তিনি পরিস্ফুটিত করেছেন চিরকালীন বেদনা, প্রেম, মৃত্যু, ভালবাসাসহ নানা বিষয়ের শৈল্পিক ব্যঞ্জনা।
×