ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গুজবেই বারবার হামলা

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২০ অক্টোবর ২০২১

গুজবেই বারবার হামলা

রহিম শেখ ॥ ২০১২ সালের শেষ দিকে ফেসবুকে কথিত কোরান অবমাননার ছবি ছড়িয়ে তাণ্ডাব চালানো হয় কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধ বসতিতে। সে সময় ১২টি বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধদের ৩০টি বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করেই। ২০১৭ সালের নবেম্বরে ফেসবুকে গুজবের সূত্র ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালেও আলোচনায় ফেসবুক। টানা এক সপ্তাহ ধরে ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে নাশকতা চলছে দেশজুড়ে। প্রথমে কুমিল্লা, এরপর চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, রংপুরসহ কয়েকটি জেলায় সা¤প্রদায়িক হামলার শিকার হয় হিন্দুদের উপাসনালয়, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রের মতে, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন আইডি থেকে এসব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির অপচেষ্টা করছে একটি চক্র। কোন ধরনের গুজবে কান না দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এবং দায়িত্বশীল নেতারা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সা¤প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানা গেছে, গত বছর কুমিল্লার মুরাদপুর এবং এর আগে একই জেলার হোমনা, পাবনার সাঁথিয়া, সাতক্ষীরার ফতেহপুরে ফেসবুকে গুজব থেকে সা¤প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ানো হয়। এবার দুর্গাপূজার মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের একটি মন্দিরে কোরান অবমাননার কথিত অভিযোগের ছবি-ভিডিও ফেসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মন্দিরে হামলা হয়, যা থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বাঁধে। কুমিল্লায় নানুয়া দীঘির পাড়ে একটি পূজামণ্ডপের ঘটনার সূত্রপাত হলেও এরপর বিকাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি মন্দিরে হামলা হয়। জানতে চাইলে কুমিল্লা মহানগর পূজা উদ্যাপন কমিটি সাধারণ সম্পাদক শিবু প্রসাদ দত্ত বলেন, ভিডিও করে সকাল ৬টার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’ বলার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘কারণ ৭টার সময় অনেক লোক, ওই লোকগুলো আসল কোথা থেকে, আর ওসিকে ৯৯৯ এ কে টেলিফোন করল। তখন কে বা কারা এটা ভিডিও করে ভাইরাল করে দিয়েছে।’ সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ঘটনার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, রংপুরসহ কয়েকটি জেলায় সা¤প্রদায়িক হামলার শিকার হয় হিন্দুদের উপাসনালয়, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন জেলায় সা¤প্রদায়িক হামলার এসব ঘটনায় মোট ৭১টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং ৪৫০ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গত কয়েক দিনের হামলার তদন্তে যুক্ত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, চলমান পরিস্থিতি ঘিরে এখন পর্যন্ত যে তথ্য তারা পাচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীরা এ পরিকল্পনা অনেক দিন আগেই সাজিয়েছিল। কোথায় কীভাবে কাজ করলে ধরা পড়ার ঝুঁকি কম থাকবে- এটা নিশ্চিত হতে অনেক এলাকায় রেকিও করা হয়। কুমিল্লায় প্রথমে যে এলাকায় তারা পরিকল্পনা করে, সেই মন্দির ও আশপাশ এলাকার কোন ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত কোন সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া যায়নি। তারা এমন এলাকা নির্বাচন করে, যেটা প্রযুক্তিগত নজরদারির বাইরে। যেহেতু এবার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকে কোন পূজামণ্ডপে স্থায়ীভাবে পুলিশ বা আনসার রাখা হয়নি; এমন পরিস্থিতিতে সব মণ্ডপ সিসিটিভির আওতায় আসছে কিনা- তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজন ছিল। অনেক এলাকায় প্রশাসন তা নিশ্চিত করেনি। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনার পরপরই এ বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০০ এর বেশি ফেসবুক লিংক বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও উসকানিমূলক কন্টেন্ট সরাতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় আমরা এবার তাৎক্ষণিকভাবে উদ্যোগ নেয়ায় ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছি। গুজবে বিশ্বাস না করতে পুলিশের অনুরোধ ॥ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। যেকোন মাধ্যমে গুজব না ছড়াতে এবং যাচাই না করে কোন খবর বিশ্বাস না করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুরোধ জানানো হয়েছে। গত সোমবার পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশে বিদ্যমান সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করতে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। অনেক ক্ষেত্রে চক্রান্তকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট বা তথ্য বিকৃত করে বা অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো গুজব ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের ওপর নজরদারি করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যেকোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছে পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ॥ এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য, গুজব ও অপপ্রচারসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর সে কারণে একটি নতুন আইন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোতে (ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও অন্যান্য) নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার। এসব মাধ্যমে গুজব প্রচার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। এমনকি ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল খুলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ কমানো ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
×