ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন বৈধ নয়

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২৯ জুলাই ২০২১

ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন বৈধ নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে ‘ক্রিপ্টো কারেন্সি’র লেনদেন বৈধ নয়। তবে এ বিষয়ে এখানে কোন আইন না থাকায় এটিকে আলাদাভাবে অপরাধ বলারও সুযোগ নেই বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এই লেনদেনের ফলে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে সেজন্য আইনী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ক্রিপ্টো কারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা এসব কথা বলেন। এর আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে পাঠানো এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে বলা হয়, ক্রিপ্টোকারেন্সির মালিকানা, সংরক্ষণ বা লেনদেন স্বীকৃত না হলেও এটিকে অপরাধ বলার সুযোগ নেই। ক্রিপ্টো কারেন্সি এক ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া এ ধরনের মুদ্রার সংখ্যা এখন আট হাজারের বেশি। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিটকয়েন। ২০০৮ সালের শেষভাগে জাপানী নাগরিক সাতোশি নাকামোতো নামের একজন বা একদল সফটওয়্যার বিজ্ঞানী এই ‘ক্রিপ্টো কারেন্সি’ উদ্ভাবন করেন। কয়েন মার্কেট ক্যাপের তথ্য অনুযায়ী, ১ বিটকয়েনের বিনিময়মূল্য গত ২৪ জুলাই সন্ধ্যায় ছিল ৩৩ হাজার ৮০৫ দশমিক ৩১ ডলার। তবে বৈধ কর্তৃপক্ষ না থাকায় ঝুঁকির আশঙ্কায় বাংলাদেশসহ কিছু কিছু দেশে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ মুহূর্তে সিআইডি দুটি মামলার তদন্ত করছে। এমন একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিআইডি মতামত চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। গত ১৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের সহকারী পরিচালক শফিউল আজম ক্রিপ্টো কারেন্সি নিয়ে ব্যাংকের অবস্থান জানান সিআইডিকে। তিনি লেখেন, ‘ক্রিপ্টো কারেন্সির মালিকানা, সংরক্ষণ বা লেনদেন স্বীকৃত না হলেও এটিকে অপরাধ বলার সুযোগ নেই মর্মে প্রতীয়মান হয়।’ ওই চিঠিতে তিনি আরও বলেন, ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের ফলাফল হিসেবে দ্বিতীয় পর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭; সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতায় অপরাধ হতে পারে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিআইডি এ নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখতে পারে। একই চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বর্তমান বিশ্বে ভার্চুয়াল মুদ্রার বাজার দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ক্রিপ্টো কারেন্সি প্রচলনের প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বের কোন আইনগত কর্তৃপক্ষ এই মুদ্রাকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বর্তমানে কয়েকটি দেশের (যেমন : জাপান, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) কেন্দ্রীয় ব্যাংক/মুদ্রা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ক্রিপ্টো কারেন্সির লেনদেনকে বৈধতা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ক্রিপ্টো কারেন্সির মতো এ ধরনের প্রাইভেট কারেন্সিতে লেনদেন বা সংরক্ষণের অনুমোদন দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ক্রিপ্টো কারেন্সি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বীকৃত কোন মুদ্রা নয়। ফলে এর লেনদেনও বৈধ নয়। সিআইডিকে দেয়া চিঠিতেও বিষয়টি বলা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে কৃত্রিম মুদ্রায় (যেমন বিটকয়েন) লেনদেন থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছিল। বিজ্ঞপ্তিতে ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বলে, ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সম্পর্কিত আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। ক্রিপ্টো কারেন্সির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও কোন নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করেনি। তবে এর মধ্যেই ক্রিপ্টো কারেন্সিকে একেবারে নাকচ করে না দেয়ার ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে সংস্থাগুলোর মধ্যে। যেমন সরকারের ইনফরমেশন এ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি ডিভিশন। ২০২০ সালের মার্চে এ বিভাগ ন্যাশনাল বøকচেন স্ট্র্যাটেজি করে। ওই কৌশলপত্রে তারা বলেছে, বøকচেন স্টার্টআপে ২০১৩ সাল থেকে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে। এই বিনিয়োগ ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। বাংলাদেশী সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিগুলোর জন্য এটা একটা সুযোগ। কিন্তু ক্রিপ্টো কারেন্সির ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকায় বাংলাদেশের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি এ আকর্ষণীয় সুযোগের বাইরে থেকে যাচ্ছে। অবশ্য ওই কৌশলপত্রে এও বলা হয়েছে, উপযুক্ত প্রযুক্তি, আইন ও নীতি কাঠামোর অনুপস্থিতিতে এ ধরনের ডোমেইন দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পথকে উন্মুক্ত করে দিতে পারে। তাই এই উভয় সঙ্কট কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, তা বিবেচনা করা উচিত। বøকচেন হলো তথ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন বøকে একটির পর একটি তথ্য চেনের মতো করে সংরক্ষণ করা হয়। ক্রিপ্টো কারেন্সির লেনদেনের তথ্য বøকচেন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। এমনিতে এই মুদ্রার লেনদেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে থাকে না। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দুজন নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করে সরাসরি এই লেনদেন করে। ২৭ থেকে ৩৪ অক্ষরের একটি আইডি খুলে ইন্টারনেটে এ্যাকাউন্ট খুলে এই মুদ্রা লেনদেন করা যায়। ভার্চুয়াল এই মুদ্রা জমা থাকে ডিজিটাল ওয়ালেটে। জানা যায়, ২০১৫ সালের দিকে নিজস্ব ই-কারেন্সি চালুর চিন্তা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন আয়ারল্যান্ডভিত্তিক একটি সংস্থা এ ধরনের মুদ্রা চালুর প্রস্তাব করেছিল। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছিলেন। ধারণাপত্রটি তখনকার গবর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় উপস্থাপিত হয়েছিল। ওই সভায় বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা ও অন্য দেশের অভিজ্ঞতা জানার পরই সিদ্ধান্ত হবে বলে জানানো হয়। এরপর আর বিষয়টি তেমন এগোয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের মুদ্রা চালু করার সময় এখনও হয়নি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালুর সময় বাংলাদেশের এখনও আসেনি। তা ছাড়া বিশ্বের কোন দেশ এ ধরনের মুদ্রা চালু করেছে সেই উদাহরণও নেই। কিছু দেশ হয়ত পাইলট প্রকল্প হিসেবে এটা চালু করেছে। তবে বাংলাদেশে এটা চালু করতে যে ধরনের সক্ষমতা দরকার তা নেই। ইন্টারনেটের বিস্তৃতি বাড়লেও তা ধীরগতির। আবার বিটকয়েনের অনুমোদন দেয়াও ঠিক হবে না। কারণ এই মুদ্রাটির রেগুলেটর বলতে কেউ নেই।’ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) প্রধান নির্বাহী আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ক্রিপ্টো কারেন্সিকে অনুমোদন দেয়ার মতো পরিস্থিতি হয়নি। ক্রিপ্টো কারেন্সির বিনিময় দুজনের মধ্যে হয়। নজরদারির কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মতো দেশে এটিকে অনুমোদন দেয়া হলে অর্থ পাচারকারীরা সুযোগ নিতে পারেন।
×