ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীমুখী মানুষের দুর্ভোগ

কঠোর লকডাউন শুরু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর

প্রকাশিত: ২২:১৮, ২৪ জুলাই ২০২১

কঠোর লকডাউন শুরু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর

আজাদ সুলায়মান ॥ একদিকে ঈদের ছুটি- অন্যদিকে কঠোর লকডাউন। এই দু’ কারণে শুক্রবার রাজধানী ঢাকা ছিল জনশূন্য। রিক্সা ছাড়া ছিল না কোন যানবাহনের উপস্থিতি। সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন তৎপরতা না থাকলেও দুপুর থেকে সেটা বাড়তে থাকে। এদিন গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরা মানুষের ঢল ছিল চোখে পড়ার মতো। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বাহনে ফিরতে দেখা গেছে। ঢাকার প্রবেশমুখ সায়েদবাদ, আবদুল্লাহপুর ও গাবতলী আমিনবাজারে দেখা গেছে মানুষকে হেঁটে শহরে প্রবেশ করতে। এ সুযোগে রিক্সচালকদের ছিল পোয়াবারো। এয়ারপোর্ট থেকে মহাখালী দুজনের রিক্সা ভাড়া পাঁচ থেকে ৭শ’ এবং গাবতলী থেকে সদরঘাট পনেরো শ’ টাকা হাঁকাতেও দেখা গেছে। কঠোরতম লকডাউনের প্রথম দিনে এমনই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীতে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকারী নির্দেশনায় পবিত্র ঈদ-উল-আজহার পর শুক্রবার সকাল থেকে ফের ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ বিধিনিষেধ চলবে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত। এবারের লকডাউন অন্য সময়ের চেয়ে যথেষ্ট কঠোর হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এবারই প্রথম বিধিনিষেধ ঘোষণার পর সরকারী প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শিল্পকারখানা ও সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। জরুরী সেবা, গণমাধ্যম ও খাদ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট পরিবহন ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহনও বন্ধ থাকবে। বিশেষ করে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকবে। রাজধানী ঢাকা থাকবে বিচ্ছিন্ন। জিরো টলারেন্সে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুক্রবার তেমন লক্ষণই দেখা গেছে। আর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও বলেছেন, আগে যাই হয়েছে এবারের লকডাউন আগের লকডাউনগুলোর তুলনায় কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। প্রতিমন্ত্রীর কথার সত্যতার আভাস মিলেছে লকডাউনের প্রথমদিনে। এদিকে ঈদ-উল-আজহার পর দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার আট লাখ ২০ হাজার মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করেছেন। আর ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত এক কোটি চার লাখ ৯৪ হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। ঢাকায় প্রবেশ করা এবং ঢাকা থেকে বের হওয়া মোবাইল ফোনের সিমের হিসাব দিয়ে শুক্রবার বিকেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এমনটি জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। মন্ত্রী একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে সেখানে লেখেন-একটু আগে ঢাকা থেকে যাওয়া ও আসা সিমের হিসাব পেলাম। চারটি অপারেটর গ্রামীণ ফোন লিমিটেড, রবি আজিয়াটা লিমিটেড, বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস ও টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের সিমের ওপর ভিত্তি করে পরিসংখ্যানটি তৈরি। শুক্রবার কঠোর লকডাউনের প্রথম দিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভোর থেকেই মাঠে নেমেছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। লকডাউন চলাকালে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মাঠে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সকালে এয়ারপোর্ট, বনানী তেজগাঁও ধানম-ি, নিউমার্কেট, শাহবাগ, মৎস্যভবন, গুলিস্তান, প্রেসক্লাব, হাইকোর্ট, বঙ্গবাজার, বংশাল, ইংলিশ রোড, সদরঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল অনেক কম। রিক্সা ও ভ্যান ছাড়া কোন যানবাহন চলছে না। অধিকাংশ এলাকা জন মানব শূন্য। মাঝে মাঝে কিছু প্রাইভেটকার ও এ্যাম্বুলেন্সকে দ্রুতগতিতে ছুটে যেতে দেখা যায়। বিভিন্ন এলাকায় ব্যারিকেড বসিয়ে পুলিশ সদস্যদের প্রাইভেটকার ও অন্যান্য যানবাহনে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায়। দুপুরে শাহবাগ চেকপোস্টে কর্তব্যরত দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বিধিনিষেধের প্রথমদিন শুক্রবার ও ঈদের ছুটি থাকায় রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি খুবই কম। যারা বাইরে বের হয়েছেন, তারা জরুরী প্রয়োজনেই বের হয়েছেন। বিধিনিষেধের প্রথমদিনে রিক্সা ও ভ্যানে করে অসংখ্য মানুষকে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। তারা গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরেছেন। গণপরিবহন সকাল ৬টা থেকে বন্ধ থাকায় তারা রিক্সা ও ভ্যানে করে বাসায় ফিরছেন। বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখে তারা আপাতত কিছু বলছেন না। তবে আগের তুলনায় এবার কঠোর বিধিনিষেধ হবে। কারণ বারবার বিধিনিষেধ দিয়ে তা কঠোরভাবে পালিত না হলে করোনা পরিস্তিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না বরং অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে। সর্বশেষ বিধিনিষেধে নানা অজুহাতে মানুষ বের হতে পারলেও এবার শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এমনকি জেলও হতে পারে। দুপুরে সদরঘাটে গিয়ে দেখা যায়- হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু যানবাহন হাতেগোনা। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে মিরপুরে যাওয়ার এক নারী ও তার স্বজন রিক্সাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দরদাম শুরু করেন। রিক্সাচালক ভাড়া দেড় হাজার টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে বাদানুবাদ। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নুসরাত জাহান শতাব্দী নামের নারী বলেন, এত টাকা রিক্সাভাড়া ভাবাই যায় না। সদরঘাট থেকে মিরপুরের রিক্সাভাড়া যদি এত টাকা হয় তাহলে উত্তরা ও এয়ারপোর্টের ভাড়া কত। তার মতো অনেকেই বিপাকে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপেক্ষাকৃত যারা অর্থবিত্তের মালিক তারা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারলেও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষ বিপাকে পড়ে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় যাদের বাসা তাদের কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ শেয়ারে ভ্যান ভাড়া করে গন্তব্যে যান। কেউ কেউ আবার পরিবার ও আত্মীয়দের ফোন করে এলাকা থেকে ভ্যান ও রিক্সা ভাড়া করে সদরঘাটে পাঠায়। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকার যাত্রীরা। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তাদের অনেকে বলেন, তারা লকডাউনের কথা মাথায় রেখে ভোর পাঁচটায় সদরঘাট পৌঁছেন। তাদের ধারণা ছিল, ভোর ছয়টা পর্যন্ত গাবতলী, সাভার ও গাজীপুর রুটে বাস চলবে। রাস্তা খালি থাকায় তারা সহজে পৌঁছতে পারবেন। কিন্তু ভোরে নেমেও দেখেন সব বন্ধ। দেখা গেছে- সদরঘাট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ। কেউ লাগেজ ও ব্যাগ থাকায় শিশু ও নারীদের নিয়ে পায়ে হেঁটে আসছেন। কেউ ভ্যান আবার কেউ রিক্সায় গাদাগাদি করে ছুটছেন। অসংখ্য পরিবারকে রাস্তার পাশে বসে থাকতে দেখা গেছে। সদরঘাট টার্মিনালের বাইরে মাত্র তিন সপ্তাহ বয়সী এক শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক দম্পতি। রিক্সার ভাড়া কয়েকগুণ শুনে আর ভাড়া বলার সাহসই করলেন না। এদিকে দুপুরের পর থেকেই রাজপথে সরব হয়ে ওঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরই অংশ হিসেবে মিরপুরে মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে নির্দেশনা অমান্য করে বের হওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এ সময় সরকারী নির্দেশনা অমান্য করায় সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের কাছ থেকে ২১ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া ট্রাফিক বিভাগের অভিযানে ছয়টি মোটরসাইকেল ও একটি রিক্সা জব্দ করা হয়। মিরপুর-১০ নম্বরের বিভিন্ন চেকপোস্টে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এক দারোগা বলেন- ‘সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় মানুষ ঘরের বাইরে কম আসছেন। কিছু মানুষ প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসছেন। সরকারী আদেশ অমান্য করায় মামলা ও জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ও বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সব গাড়ি চেকপোস্টে থামানো হচ্ছে এবং ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা জানতে চাইছেন, কেন বের হয়েছেন, কোথায় যাবেন। সুনির্দিষ্ট কারণ ও প্রমাণ দিতে না পারলে তাদের বাসায় পাঠানো হচ্ছে। মিরপুর গোলচক্করের চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ফরহাদ বলেন, চেকপোস্ট চলমান আছে। আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেকেই ঈদের ছুটিতে ঘুরতে বের হয়েছিলেন। তাদের বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। একাধিক চেকপোস্টে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ট্রাফিক পুলিশ। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে। উল্লেখ্য এবারের বিধিনিষেধ সবচেয়ে কঠোর হবে বলে সরকারের তরফে আগেই জানানো হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় গত ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ দেয়া হয়। তবে ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে গত ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত বিধিনিষেধ শিথিল করে সরকার। পরে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
×