ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

সরকারী সংস্থাকে নিজেদের টাকায় চলতে হবে

প্রকাশিত: ২৩:১১, ৫ মে ২০২১

সরকারী সংস্থাকে নিজেদের টাকায় চলতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিগুলোকে নিজস্ব আয় থেকে ব্যয়ের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মঙ্গলবারের সভায় তিনি এমন নির্দেশনা দেন। একনেক সভা শেষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সভা শেষে মন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া একনেক সভায় ১১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা ব্যয় মোট ১০টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকার দেবে ৮ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। বাকি টাকা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে বলে মন্ত্রী জানান। মঙ্গলবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন একনেক চেয়ারপারর্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সরকারী সংস্থাগুলো তো নিজেরা আয় করে। তাহলে যে টাকা আয় করে, সেই টাকা দিয়ে কেন চলতে পারে না। কেন সরকারের দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। সরকারী সংস্থাগুলোকে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো এবং স্বাবলম্বী হওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারী কোষাগার থেকে সংস্থাগুলোকে টাকা দেয়া হবে না বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। তাহলে সরকারী সংস্থাগুলো কীভাবে চলবে-এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আপনি ব্যবসা করবেন, সেখানে তো আমি গিয়ে বুদ্ধি দিতে পারি না। আপনি ব্যবসা করেন, তাই আপনিই বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করুন। সকাল-সন্ধ্যায় যদি মন্ত্রী-সচিবেরা সংস্থাগুলোকে বুদ্ধি দিতে যান, সেটা নিশ্চয়ই ভাল দেখাবে না।’ সরকারী সংস্থাগুলো নিজেদের টাকায় চলার বিষয়টি আলোচনায় আসে মঙ্গলবার একনেকে বিটিসিএলের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিতে গিয়ে। ৯৫ কোটি টাকা খরচে ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে টেলিযোগাযোগ স্থাপন’ শিরোনামের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রকল্প তো বিটিসিএল নিজেদের টাকায় বাস্তবায়ন করতে পারে। কারণ, তারা নিজেরা আয় করে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে সরকারী কোষাগারের টাকা দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকল্প বাস্তবায়নে না দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সরকারপ্রধান থেকে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের টাকায় চলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে খাল খনন প্রকল্পের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সাবধান! খাল খননের নামে যেসব কা- হয়! এটা তিনি (প্রধানমন্ত্রী) জানেন। আমরাও সবাই মোটামুটি জানি। তিনি (শেখ হাসিনা) বলেছেন, সেচে সেচে উপরের দিকে দেখিয়ে। মানে দেখাবার একটা প্রবণতা আছে। সেদিকে আমাদের তিনি সাবধান করেছেন।’ একনেক সভায় ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধীনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে মানুষকে সেবা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা দীর্ঘদিন ঝুলে আছে তাড়াতাড়ি শেষ করেন আর কতদিন সময় নেবেন? একনেক সভায় ১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে উপজেলা পর্যায়ে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এ প্রকল্প প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সবার জন্য শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম উন্মুক্ত থাকতে হবে। কোন ক্লাবের আওতায় থাকবে না, কোন ব্যক্তির আওতায় থাকবে না। হয়তো ইউএনও দেখভাল করতে পারবেন। স্টেডিয়ামগুলোতে শুধু ছেলে নয়, মেয়েরাও যেন খেলাধুলা করতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। সভায় ‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এ প্রকল্প প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাল খনন নিয়ে সাবধান। ওপর দিয়ে লোক দেখানো খনন নয়, এটা গভীরভাবে খনন করতে হবে, যাতে করে শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা এই পানি সেচ কাজে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এদিকে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, একনেক সভায় ১১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা ব্যয় মোট ১০টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকার দেবে ৮ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। বাকি টাকা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে। একনেকে অনুমোদিত ১০টির মধ্যে একটি সংশোধিত এবং নয়টি নতুন প্রকল্প। সংশোধিত প্রকল্পটি হলো ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপন’। সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ দুই বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকল্পটির মূল খরচ ছিল ১ হাজার ৩৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধনীতে ১৯৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা খরচ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ হাজার ৫৬১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। নতুন প্রকল্পগুলো হলো ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পে খরচ করা হবে ৯৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘সাইনবোর্ড-মোড়েলগঞ্জ-রায়েন্দা-শরণখোলা-বগী সড়কের (আর-৭৭৩) ১৭তম কিলোমিটারে পানগুচি নদীর ওপর পানগুচি সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পটি ৯১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা খরচ করা হবে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ‘উপজেলা পর্যায়ে শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পে ১ হাজার ৬৪৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ প্রকল্প ৫২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা খরচে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এটি ২০২১ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘রাঙ্গামাটি জেলার কারিগর পাড়া হতে বিলাইছড়ি পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন ও ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ’ প্রকল্পটি ৩৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পটি ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। এটি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। একনেক সুপারিশে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য মোঃ জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর জেলার ৩৪টি উপজেলার সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবহন ব্যয় হ্রাস এবং কৃষি ও অকৃষি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এজন্যই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ’ প্রকল্পটি ১ হাজার ১৫৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি ১ হাজার ৪৫২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। বিদ্যুত বিভাগের ‘বাপবিবোর বৈদ্যুতিক বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ক্ষমতাবর্ধন (খুলনা বিভাগ)’ প্রকল্পটি ৩ হাজার ৭৬ কোটি ২২ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। এটি ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। কৃষিমন্ত্রী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীরা সভায় অংশ নেন। এ সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×