ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

গোলাম মোরশেদ

চাকরি প্রত্যাশীদের ওপর করোনার প্রভাব ও করণীয়

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১৫ মার্চ ২০২১

চাকরি প্রত্যাশীদের ওপর করোনার প্রভাব ও করণীয়

২০২০ সালে আবির্ভূত করোনাভাইরাস যে সকল ব্যক্তি বা দলের ওপর তুলনামূলক বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে তাদের মধ্যে নতুন চাকরিপ্রত্যাশীরা অন্যতম; যাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ-তরুণী। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে নতুন প্রবেশ করে। এদের মধ্যে কর্মসংস্থান কিংবা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ৬-৭ লাখ দেশের বাইরে যায়। অবশিষ্ট ১১-১২ লাখের জন্য দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হয়। কিন্তু করোনার প্রভাবে এই চাকরিপ্রত্যাশীদের পরিমাণ ও চাপ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘ ৮-৯ মাস হলো দেশে নতুন নিয়োগ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। আবার নতুন নিয়োগ স্থগিতের পাশাপাশি অনেকেই পূর্বতন চাকরি হারিয়েছেন। করোনাকালে সরকারী ও বেসরকারী চাকরির বিজ্ঞপ্তিও ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও বর্তমানে বেশিরভাগ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক খুঁজছে। তাই নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য কিছু বিশেষ পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) অনুযায়ী বর্তমান শ্রমবাজারে ২৯ বছরের কম বয়সী তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আবার তাদের মধ্যে বেকারত্বের হারও সবচেয়ে বেশি। দেশে যেখানে সামগ্রিকভাবে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ সেখানে তরুণ-তরুণীদের মাঝে বেকারত্ব আরও ৩ গুণ বেশি। বর্তমানে দেশের শ্রমশক্তিতে ৬ কোটি ৩৫ লাখ কর্মক্ষম লোক নিয়োজিত, যার মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২ কোটি ৮৩ হাজার এবং তাদের মধ্যে কর্মজীবী মাত্র ১ কোটি ৭৯ লাখ। এই জরিপ অনুযায়ী সারাদেশে কর্মহীনের সংখ্যা ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে আনুমানিক ২২ লাখেরই বয়স ২৯ বছরের কম। বর্তমানে প্রায় এক কোটি প্রবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। করোনার প্রভাবে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েক লাখ শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। কিন্তু করোনাকালীন বিভিন্ন জটিলতায় ছুটিতে ফেরা প্রবাসীদের অনেকেই পূর্বের কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। শুধু এজন্যই এ বছর দেশের অভ্যন্তরে নতুন করে আরও বেশি কর্মের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে যারা কিনা দেশের বাইরে কর্মে জড়িত হতেন। আবার প্রতিবছর গড়ে যেখানে ৭ লাখ লোক প্রবাসে পাড়ি জমান সেখানে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে মাত্র ২,১৭,৬৬৯ জন প্রবাসে যেতে পেরেছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক মন্দাভাবের প্রভাবে নতুন চাকরির সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। আবার যারা প্রবাসেই অবস্থান করছেন তাদেরও অনেকের চাকরির সুযোগ কমে গেছে। দেশে যেখানে তরুণদের বেকারত্বের হার সামগ্রিক গড় হারের তিনগুণ সেখানে আবার করোনার প্রভাবে এই তরুণদের মাঝেই বেকারত্বের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ট্যাকলিং দ্য কভিড-১৯ ইয়ুথ এমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া এ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ (আগস্ট, ২০২০) শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, করোনায় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। তারা উল্লেখ করে যে, করোনার আগে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ১২ শতাংশ, যা এরই মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া করোনার সংক্রমণ যত দীর্ঘমেয়াদী হচ্ছে এই প্রভাবও তত দীর্ঘমেয়াদী হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে নতুন চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণীদের চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও ভাটা পড়েছে। নতুন চাকরিপ্রত্যাশী কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, তাদের বেশিরভাগই চাকরির প্রস্তুতির জন্য পরিবারের বাইরে মেস বা হলে বাস করতেন। কিন্তু করোনাকালীন সাধারণ ছুটি ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশিরভাগই মেস বা হল ত্যাগ করেছিলেন। এ সময় তারা গ্রামে অবস্থান করেছেন। এই অস্থিতিশীল অবস্থায় তারা যথাযথভাবে চাকরির প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেননি। এই অস্থিতিশীল সময়ে তাদের জন্য নতুন করে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠা যেমন কঠিন ছিল তেমনি পূর্বের প্রস্তুতিতেও ভাটা পড়েছে। চাকরির জন্য তাদের পুনরায় শুরু থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। আর এই সময়ে যেহেতু সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা স্থগিত ছিল এ কারণে তারা কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিলেন। সম্প্রতি কিছু সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করলেও তা পরিমাণে খুবই কম। এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সরকারী-বেসরকারী চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী না করে সর্বোচ্চ দ্রুত করতে হবে। ইতোমধ্যে স্থগিত থাকা নিয়োগ কার্যক্রমগুলো যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। শূন্য পদগুলোতে অতি দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মহীনদের চাহিদার ভিত্তিতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, যা দেশের ভেতর ও বাইরে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করবে। পড়াশোনা কিংবা কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ যেতে আগ্রহীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। এতে দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থানের চাপ হ্রাস পাবে। নিয়োগদানের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে যারা স্থায়ী কর্মে যুক্ত আছেন তাদের তুলনায় কর্মহীনদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফলে শূন্য পদ সৃষ্টির কাঠামোগত ক্ষতি (সিস্টেম লস) হ্রাস পাবে। প্রচলিত নিয়োগ পরীক্ষার বাইরে নিয়োগ পরীক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়োগ পরীক্ষা ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। স্বল্প পরিসরে হলেও অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। যে সকল পরীক্ষার ক্ষেত্রে একাধিক স্তরের পরীক্ষা পদ্ধতি (এমসিকিউ, লিখিত ও ভাইভা) অনুসরণ করা হয় সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে একটি বা সর্বোচ্চ দুটি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে। ফলে নিয়োগ কার্যক্রমে সময়ক্ষেপণ হ্রাস পাবে। এক্ষেত্রে একদিনেই এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিয়োগদানের ক্ষেত্রে প্রার্থীর নির্দিষ্ট চাকরি পরীক্ষার ফলাফলের পাশাপাশি অন্যান্য অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। সার্বজনীন পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করতে হবে। যেমন, চিকিৎসক নিয়োগে চিকিৎসা বিজ্ঞানবিষয়ক প্রশ্নপত্র, প্রকৌশলী নিয়োগে প্রকৌশল বিষয়ক প্রশ্নপত্র ইত্যাদি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে হ্রাসযোগ্য অপচয় দূর করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। চাকরিপ্রত্যাশীদের যাদের বয়স ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছে তাদের ক্ষেত্রে আগামী এক বছর বয়সসীমা শিথিল করা যেতে পারে। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট, লেবার এ্যান্ড পিজ্যান্ট ডিভিশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট [email protected]
×