ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জলি রহমান

সম্ভাবনাময় ফুল বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০০:৫৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সম্ভাবনাময় ফুল বাণিজ্য

সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতার প্রতীক ফুলের প্রতি মানব প্রেম চিরন্তন। তাই ফুলের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বর্তমানে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। বসন্ত, ভালবাসা দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে হয় ফুলের রমরমা বাণিজ্য। সারাদেশে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। চাষীদের মুখে লেগে থাকে প্রশান্তির ছোয়া। বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ফুল দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। আমরা জানি ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে গদখালী ইউনিয়ন। যা বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। এই ইউনিয়নে ১৯৮২ সালে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু হয়। বর্তমানে দেশের মোট ফুলের ৭০ শতাংশ উৎপাদিত হয় গদখালীতে। যা থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা। সীমিত পরিসরে রফতানিও হয়ে থাকে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে উৎপাদন বেশি। আর ফেব্রুয়ারিতে বিক্রয় বেশি। গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, জারবারা, গ্লাডিউলাস, জিপসিসহ প্রায় ১১ প্রজাতির বাহারি ফুলে ছেয়ে গেছে ঝিকরগাছা উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম। ঝিকর গাছা উপজেলার কৃষি অফিসার মাসুদ হোসেন পলাশ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘এখানে ৬৩০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। ছয় হাজার চাষী সরাসরি ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ১ লক্ষ্য পরিবার এর উপর নির্ভরশীল। গত বছর বসন্ত, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস, ২৬ মার্চ, পহেলা বৈশাখ ঘিরে আমাদের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। এবার আমফানের কারণে কৃষি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও আমরা আশাবাদী ফুলের ন্যায্যমূল্য পেলে এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে।’ করোনার ক্ষতি কিভাবে পুষিয়ে উঠেছে এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘দুই রকমের ফুল চাষী আছে স্থায়ী এবং অস্থায়ী। করোনা মহামারীর সংকটকালে অস্থায়ী ফুল চাষীদের অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। তখন ধান সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমরা কৃষকদের টমেটোর চারা দিয়েছি যা এখনও চলমান। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি হয়েছে এবং ভুট্টা, সরিষা চাষীদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল। এছাড়াও বর্তমান সরকার সহজ শর্তে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার ফলে আমরা কৃষি ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করছি।’ শাহবাগের এক ফুল বিক্রেতা বললেন, ‘আমি ১০ হাজার গোলাপ ফুল নিয়ে এসেছিলাম। সবগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। ফুলের বাজার খুব ভাল পেয়েছি। আমরা খুব খুশি। এবার ফুলের দাম অনেক।’ ফলন ভাল হওয়ার পাশাপাশি এবার দেশের পরিবেশ স্থিতিশীল থাকায়, নির্ধারিত সময়ে ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র বাজার যদি ভাল যায়। তাহলে এ বছরের যে লক্ষ্যমাত্রা ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা তা পূর্ণ হবে। এছাড়াও প্রতিবছর জেলাটিতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। এবারও সেই ধারা অব্যাহত রাখতে দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে চাষী ও বিক্রেতারা।’ বাংলাদেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩,৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫,০০০ কৃষক এবং ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায়ে অন্তত দেড় লাখ মানুষ সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন। ফুল সেক্টরের কার্যক্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। ফুল শিল্পের সম্প্রসারণের ফলে সামাজিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রে যেমন-বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, পূজা পার্বণে ফুলের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ভোগ্যপণ্য সানফ্লাওয়ার ওয়েল অত্যন্ত জনপ্রিয়। যা সূর্যমুখী ফুল দিয়ে তৈরি। তাই ব্যাপকভাবে এ ফুলের বাণিজ্যিক চাহিদাও বাড়ছে। ফুল শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে গত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ সালের হিসাবে গড় প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। ফুল উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২০ শতাংশ, বিক্রীত মূল্যের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২৬ শতাংশ, খুচরা বাজারে বিক্রয়ের গড় প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ, তবে উৎপাদন এলাকা বৃদ্ধির হার মাত্র ১৫ শতাংশ যা অপেক্ষাকৃত কম। সার্বিকভাবে ফুল শিল্পের বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- ফুল চাষ ধান ও শাকসবজির তুলনায় অনেক বেশি লাভজনক। এছাড়াও ফুলের চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি, হেক্টরপ্রতি অধিক লাভ, ফুলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি গ্রহণ, অর্থনৈতিক উন্নতি, অন্যান্য জেলায় ফুলের চাষ বৃদ্ধির সুযোগ, শহরের মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফুল ক্রয়ের ব্যাপক অভ্যাস ও উৎসাহ। ঢাকার শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে পাইকারি ফুলবাজার রয়েছে। এখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা ফুল কিনে ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েন। কেন্দ্র্র্রীয় ফুলবাজার নির্মাণের দাবি বহু আগে থেকেই করে আসছেন ফুল বিক্রেতারা। কৃষি বিপণন অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘বাজার অবকাঠামো, সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে ফুল বিপণন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের’ মাধ্যমে ঢাকার গাবতলীতে একটি ফুলের পাইকারি বাজার নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর ব্যাপক প্রশিক্ষণের আয়োজন, ফুলের বীজ ও চারা আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফ, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফুলের স্থায়ী পাইকারি বাজার স্থাপন, পরিবহনকালে ফুল জাতে বিনষ্ট না হয় তার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু, যশোরে ফুলের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন, দক্ষিণাঞ্চলের ফুল উৎপাদনকারী এলাকাগুলোতে বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বেসরকারী ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা কর্তৃক ঋণের সুযোগ বৃদ্ধি, সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফুল সেক্টরে মহিলা উদ্যোক্তাদের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় ফুলনীতি প্রণয়ন। ইউএসএআইডির সহযোগিতায় গদখালীর পানিসারা গ্রামে একটি ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে যেখানে কোল্ডস্টোরেজ সুবিধার মাধ্যমে ফুল ও ফুলের বীজ সংরক্ষণ করা যাবে। কৃষি বিপণন অধিদফতরের মাধ্যমে পানিসারা গ্রামে একটি এ্যাসেম্বল সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে ফুলচাষী ফুল বিক্রয় করতে পারবেন। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ এবং ঢাকার সাভারে আরও তিনটি এ্যাসেম্বল সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। ভারত ও চীন থেকে বিশেষজ্ঞ চাষীদের আনা হচ্ছে স্থানীয় কৃষকদের সহায়তার জন্য বিশেষ করে পলি হাউসগুলো তৈরিতে আবার বিএডিসি যে গবেষণা করে সেখানেও তারা সহায়তা করেন। নিত্যনতুন জাতের ফুলের চাষের জন্য আলাদা জ্ঞানের দরকার হয় এবং সেটি তারা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাচ্ছেন। এতসব উদ্যোগের কারণেই অন্য ফসলের চেয়ে ফুল চাষেই চার পাঁচগুণ বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। ফলে গদখালীর ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে দেশ দেশান্তরে।
×