ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সেনা ও নৌবাহিনীর জাহাজে সুখময় যাত্রা স্বেচ্ছায় শঙ্কামুক্ত জীবনে যাওয়ার আগ্রহ বাড়ছে

১৬৪২ রোহিঙ্গা ভাসানচরে

প্রকাশিত: ২২:২৫, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

১৬৪২ রোহিঙ্গা ভাসানচরে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশী-বিদেশী বহুমুখী ষড়যন্ত্র। স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার প্রচণ্ড বিরোধিতা। এছাড়া খোদ বিশ্ব অভিভাবক সংস্থার পক্ষে এ কাজে তাদের সম্মতি নেই বলে জানান দেয়া হয়েছে। কিন্তু ছিন্ন করে ফেলা হলো সকল বাধা-বিপত্তি। এ জাতীয় নানা চাপ-জটিলতার পাহাড়কে ডিঙ্গিয়ে শুক্রবার ১৬৪২ রোহিঙ্গাকে আনন্দ ও উল্লাসমুখর পরিবেশে সাগরপথে নির্বিঘ্নে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে পৌঁছানো হয়েছে। এদের ৬০ শতাংশ নারী ও শিশু। অবশিষ্টরা পুরুষ। অস্থায়ী হলেও ঘিঞ্জির আবাস ও মানবেতর পরিবেশ থেকে মুক্তজীবনের আশায় তারা বুক বেধেছে। ক্যাম্পে বন্দীর মতো হয়ে থাকার পরিবর্তে খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস ফেলার জীবন তাদের আশান্বিত করেছে। ভাসানচরে যারা পৌঁছেছে তাদের অধিকাংশই জানিয়েছে, অভ্যন্তরীণ কোন চাপের মুখে নয়, স্বপ্রণোদিত হয়েই তারা নতুন জীবনের জন্য নতুন স্থানের পথ বেছে নিয়েছেন। তারা আশা করছেন আগামীতে আরও বহু রোহিঙ্গা ভাসানচরে চলে আসবে। অপরদিকে, মালয়েশিয়া যাওয়ার সাগরপথে বিতাড়িত হয়ে ভাসানচরে আশ্রিত ৩০৬ রোহিঙ্গাকে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নৌবাহিনীর জাহাজযোগে নিয়ে আসার কথা রয়েছে। পরবর্তীতে তারা তাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যারা আগ্রহী হবে তাদের নিয়ে ভাসানচরে যাবে বলে জানিয়েছে। এদিকে, প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এবার বড় দল নয়, অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে ভাসানচরে নেয়ার ও পৌঁছানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এভাবে ১ লাখেরও কিছু বেশি রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। শুক্রবার সকালে শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা কর্ণফুলী নদীর মোহনা হয়ে বঙ্গোপসাগরের নির্দিষ্ট রুট ধরে নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর ৮ জাহাজযোগে মালামাল এবং রসদ নিয়ে রোহিঙ্গাদের নতুন এই ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরমধ্যে নৌবাহিনীর ৭টি ও সেনাবাহিনীর একটি জাহাজ রয়েছে। সেনাবাহিনীর জাহাজটির নাম ‘শক্তি সঞ্চার’। স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় পতেঙ্গার তিনটি স্পট থেকে রোহিঙ্গাদের জাহাজে উঠানো হয়। এই তিনটি পয়েন্ট হচ্ছে বোট ক্লাব জেটি, কোস্টগার্ড জেটি ও নৌবাহিনীর আরআরবি (রেডি রেসপন্স বার্থ) জেটি। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের অনিন্দসুন্দর এই প্রকল্পটি গড়ে তোলা হয়েছে নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ঠিকাদারসহ সহযোগী বিভিন্ন সংস্থার অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বীপটিকে করা হয়েছে বসবাসযোগ্য। স্থানান্তর রোহিঙ্গাদের টানা ১৪ দিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুত করা খাবার সরবরাহ করা হবে। এরপর তাদের নিজ নিজ বাসস্থানে নিজেদের উদ্যোগে রান্না করে খাওয়ার প্রক্রিয়ায় আনা হবে। এদিকে, ভাসানচর দ্বীপটির নিয়ন্ত্রক নোয়াখালী জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলম খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সার্বিক ব্যবস্থার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দীপক জ্যোতি খিশা জানিয়েছেন, ১২০টি ক্লাস্টার নিয়ে তৈরি ভাসানচরে ১ লাখ মানুষের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে। যে কোন ধরনের বেআইনী কর্মকাণ্ড রোধ করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের সকল কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে পারে তা নিয়ে তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন হলেও হাতিয়ার অনতি দূরে অবস্থিত সেখানে মানুষের বসবাসের সকল সুব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়েছে। এমনকি মোবাইল ফোনের ব্যবহারের জন্য থ্রি জি, ফোর জি সুবিধা করা হচ্ছে। এর আগে শুক্রবার সকালের পর থেকে রাত অবধি ‘চল চল ভাসান চর চল’, স্টিকার লাগানো বিভিন্ন বাসযোগে একে একে ব্যাপক নিরাপত্তাধীনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসা হয় পতেঙ্গার বিএফ শাহীন স্কুল প্রাঙ্গণে। নিয়ে আসার আগে উখিয়ায় তাদের ‘চাটগাইয়া মেজবান’-এ আপ্যায়িত করা হয়। আসার পথে বাসে সকলকে পরিবেশন করা হয় নাস্তার প্যাকেট। চট্টগ্রামে পৌঁছার পর রাতের বেলা ভাত এবং শুক্রবার সকালে জাহাজে ওঠার পর নাস্তা এবং পৌঁছানোর আগে খাবার পরিবেশন করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার পর একের পর এক ৭ জাহাজযোগে রোহিঙ্গাদের এবং আরেকটি জাহাজে তাদের মালামাল ও রসদ নিয়ে রওনা করা হয়। বেলা ৩টার কাছাকাছি সময়ে সব জাহাজ ভাসানচরের নবনির্মিত জেটিতে ভিড়ে। সেখানে প্রকল্প পরিচালক কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দৌজা, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আগত রোহিঙ্গাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। এরপর তাদের একে একে জাহাজ থেকে নামিয়ে অপেক্ষার স্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের নাম, ঠিকানা, সংখ্যা, পরিবারভিত্তিক তথ্য পুনরায় মিলিয়ে উঠানো হয় বসতি স্থানে। চট্টগ্রাম থেকে ভাসানচরে যাওয়ার পথে রোহিঙ্গারা ছিল নবজীবনের আশায় উদ্বেলিত। অনেকে নৌবাহিনীর জাহাজ দেখে এবং জাহাজ অভ্যন্তরের পরিবেশ নিয়েও ছিল আনন্দিত। এদের অনেকের সঙ্গে কথা বললে জানানো হয়, তারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাচ্ছে। উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় শিবিরগুলোতে ভাল পরিবেশ নেই। নিয়মিত খাদ্য সহায়তা পেলেও তাদের সন্তানদের শিক্ষার সুব্যবস্থা নেই। রোহিঙ্গা নেতাদের মুখ থেকে ভাসানচরের কথা তারা শুনেছে। এছাড়া ভাসানচরের ভিডিও চিত্র দেখে তারা সেখানে গিয়ে বসবাসের আশায় বুক বেঁধেছে। কেউ তাদের দূর করেনি। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের বিভিন্নভাবে ভীতি প্রদর্শন করেছে ভাসানচরে না যাওয়ার জন্য। এরপর উন্নত পরিবেশের আশায় তারা সকল বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছে। তাদের সকলের আশা ভাসানচরে তারা জীবনের নতুন উপাদান খুঁজে পাবে। সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে এই প্রক্রিয়ায় উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নতুন আশার আলো ছড়াচ্ছে। এনজিও ফোরামের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রমের এই কর্মকাণ্ডকে অভিনন্দিত করেছে। সপ্তাহখানেক পরে আরও একটি দলকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ধাপে ধাপে নেয়া হবে লক্ষাধিক। ভাসানচরে ১ লাখ ১ হাজার ৩৬০ জনের বসবাসের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতমানের ভবন, সুযোগ সুবিধা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, খেলাধুলার মাঠ, চাষাবাদের জমি এবং সর্বোপরি জলোচ্ছ্বাস ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে এ কাজে ব্যয় করা হয়েছে ৩১শ’ কোটি টাকারও বেশি। প্রসঙ্গত, পশ্চিমা বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক খেলার শিকার রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা। সে দেশের সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত অত্যাচার, নির্যাতনে নিপীড়িত হয়ে লাখে লাখে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পে ওদের বসবাস। সরকারের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী এনজিও এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সহায়তায় ওরা এ দেশে প্রাণে বেঁচে আছে। কিন্তু উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয়দের জমি-জমা ও পাহাড়ি এলাকায় এদের আশ্রয় ক্যাম্পের পরিবেশ একেবারেই ঘিঞ্জি এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনেকের জন্য মানবেতরও বটে। কিন্তু কিইবা করার আছে। মিয়ানমার সরকার তাদের এ নাগরিকদের প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশের চাপের মুখে দু’দফায় প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক করেও তা সফল যায়নি। এক্ষেত্রে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পরিবেশ সৃষ্টি করেনি। আর প্রাণে বেঁচে থাকার পরিবেশ ও নাগরিকত্বের অধিকার ছাড়া আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে মোটেও আগ্রহী নয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ওপর তারা বড় ধরনের বোঝায় পরিণত হয়েছে। এরপরও সম্মানের সঙ্গে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশ সরকার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ওপর ভর করেছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসী তৎপরতা। চুরি, ডাকাতি বেড়েই চলেছে। রাতের বেলা প্রতিটি শিবির সন্ত্রাসীদের অভয়রাণ্যে পরিণত হয়ে যায়। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন শিশুর দল। ফলে বেড়েই চলেছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জনসংখ্যা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার বিষয়টি আগে থেকে অনুধাবনে এনেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোয়াখালীর হাতিয়ায় জেগে ওঠা ভাসানচরে গৃহহীনদের জন্য যে ইকো ফ্রেন্ডলী সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট গ্রহণ করে সেখানেই অস্থায়ীভাবে উখিয়া-টেকনাফের ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ভাসানচর দ্বীপটিকে সাজানো হয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর পরিকল্পনা। শহর নয় অথচ শহুরে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন রাখা হয়েছে। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এই দ্বীপ যাতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে শতবছরেরও বেশি সময়ের পরিসংখ্যান নিয়ে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। দ্বীপের অভ্যন্তরভাগে পশু-পাখি পালন, মাছ চাষের এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিবারাত্রি বিদ্যুত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে রাতের বেলা এই দ্বীপটিকে দেখা যায় আলো জলমলের এক দৃষ্টিনন্দন পরিবেশে।
×