ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গৃহহীন পাঁচ শতাধিক

মোহাম্মদপুরে বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, শতাধিক ঘর পুড়েছে

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৫ নভেম্বর ২০২০

মোহাম্মদপুরে বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, শতাধিক ঘর পুড়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার মহাখালীর সাত তলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই মোহাম্মদপুরের একটি বস্তিতে মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে, আশপাশের মানুষ বাসা বাড়ি ফেলে জীবন বাঁচাতে নিরাপদ জায়গায় চলে গেছেন। টানা এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। অগ্নিকাণ্ডের কারণে মোহাম্মদপুরের অলিতে গলিতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। তার প্রভাব পড়েছে আশপাশের এলাকায়। যানজটে নাকাল সেখানকার বাসিন্দারা। মঙ্গলবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানাধীন বাবর রোডের জহুরী মহল্লার উর্দুভাষী অবাঙালীদের বিহারী পট্টি লাগোয়া বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাদী সুলতানা জনকণ্ঠকে জানান, আগুন নেভাতে দুই দফায় ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট পাঠানো হয়। বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। তবে আগুনে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। আগুনের কারণে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। রাস্তায় যানজটও হয়েছিল। আগুনের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। বস্তির বাসিন্দারা জানান, বস্তিটিতে অন্তত ৩ থেকে চার ৪ হাজার ঘর আছে। বস্তি ঘরগুলো বাঁশ, কাঠ আর ইট সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা। বস্তির মাঝে কিছু আধা পাকা স্থাপনা রয়েছে। তবে অধিকাংশই বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর। টিনের চাল আর বেড়াও টিনের। বেলা চারটার দিকে আচমকা বস্তিটির মাঝ বরাবর আগুন লাগে। মুহূর্তেই সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। বাসিন্দাদের দাবি, শীতের সময় বাঁশ কাঠ শুকনো থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। আর বস্তির ভেতরে অনেকেই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। সেইসব গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েও আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারা কোনমতে ঘর থেকে জীবন নিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছেন। ঘরের ভেতরে থাকা সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যার মধ্যে নগদ টাকাও আছে। বস্তির অনেকেরই দাবি, এখানে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। তাদের অধিকাংশই দিন আনে দিন খায়। তাদের কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। তারা ঘরেই টাকা জমায়। টাকা চুরি হওয়ার ভয়ে তারা সঙ্গেই টাকা রাখেন। আবার অনেকেই ঘরের মেঝে খুঁড়ে টাকা রাখেন। যাতে আগুন সব পুড়ে গেলেও মাটির নিচে থাকা টাকা না পুড়ে। সব মিলিয়ে বস্তিটির শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। এতে গৃহহীন হয়ে পড়েছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষ। তারা এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। তাদের উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ব্র্যাকের তরফ থেকে তাৎক্ষণিক সাড়াদান কর্মসূচীর মাধ্যমে কিছু কিছু কাপড়, প্লেট, গ্লাসসহ ব্যবহারিক জিনিসপত্র দেয়া হয়েছে। এর আগে গত সোমবার রাত পৌনে বারোটার দিকে মহাখালী সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট টাকা সোয়া এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাও সম্ভব হয়নি। তবে আগুনে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বস্তির বাসিন্দারা জানান, ফায়ার সার্ভিস সকাল ছয়টা পর্যন্ত সেখানে কাজ করে। এরপর নতুন করে আগুন লাগার সম্ভাবনা না থাকায় তারা চলে যান। মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, আগুনে টিনগুলো পুড়ে দুমড়ে মুচড়ে গেছে। রাস্তায় শত শত মানুষ আহাজারি করছেন। তাদের সবারই ঘর পুড়ে গেছে। সেখানে কথা হচ্ছিল সালেকা (৫০) নামের মহিলার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, আমি পেশায় মাটি কাটার কাজ করি। বাড়ি শেরপুর জেলার নকলা থানাধীন চান্দানগর গ্রামে। ১৮ বছর ধরে তিনি এই বস্তিটিতে বসবাস করছেন। তার তিন মেয়ে আর একমাত্র ছেলের জন্মও এই বস্তিতেই। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে রিক্সাচালক। কিছু দিন আগে বিয়ে করেছিল। স্ত্রী মরে গেছে। ছেলের সঙ্গেই থাকছেন তিনি। মাসিক দুই হাজার টাকা তার ঘর ভাড়া। সোমবার রাত আনুমানিক পৌনে একটার দিকে আচমকা বস্তিতে আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনতে পাই। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি আশপাশের সব বস্তিঘরে আগুন লেগে গেছে। যদি ঘরের জিনিসপত্র রক্ষা করতে যাই, তাহলে হয়তো জীবন রক্ষা করতে পারব না। তাই কোন কিছু না ভেবে মাথার কাছে থাকা মোবাইলটি নিয়ে এক কাপড়ে দৌড়ে বস্তি থেকে বাইরে বেরিয়ে গেছি। ঘরে দশ হাজার চারশ’ টাকা ছিল। তা আর নিতে পারিনি। সবই পুড়ে গেছে। আমার মতো অনেকেরই একই অবস্থা। বস্তিতে অনেকেই ঘরেই টাকা জমায়। অনেকেই সেসব টাকা আর নিয়ে বেরুতে পারেন না। ফলে বহু টাকা পুড়ে যায়। আবার অনেকে মাটির নিচে পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে টাকা গর্ত করে পুঁতে রাখেন। তাদের টাকা হয়তো রক্ষা পায়। কিন্তু বস্তির অধিকাংশ ঘরের মেঝে পাকা। এজন্য অনেকেই ইচ্ছা করলেই পাকা ফ্লোর ভেঙ্গে টাকা মাটিতে পুঁতে রাখতে পারেন না। তাদের টাকা পুড়ে গেছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে করা তালিকা মোতাবেক এবং ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি অনুসারে, বস্তিটির অন্তত একশ’ ৬১টি ঘর পুড়ে গেছে। যার মধ্যে ১৩১টি বসতঘর। আর ৩০টি বিভিন্ন ধরনের দোকান। বস্তির সামনে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত হাজার খানেক বস্তিবাসী। কারণ আগুন নেভানোর সময় অনেক বাড়ি পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেসব বাড়ির মানুষজনও গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। সেখানে ব্র্যাকের তরফ থেকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে বস্তিবাসীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের তরফ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
×