ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গড়ে উঠেছে বৃহৎ শিল্প আসছে বিদেশী বিনিয়োগ

দশ বছরে নির্মাণসামগ্রী খাতের আকার দ্বিগুণ ॥ রফতানি হচ্ছে রড সিমেন্ট সিরামিক

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৫ নভেম্বর ২০২০

দশ বছরে নির্মাণসামগ্রী খাতের আকার দ্বিগুণ ॥ রফতানি হচ্ছে রড সিমেন্ট সিরামিক

রহিম শেখ ॥ দেশের আবাসন খাতের ওপর ভিত্তি করে রড, সিমেন্ট, সিরামিক, রং, ইট, বালুসহ ২৬৯টি উপখাত গড়ে উঠেছে। মাত্র দশ বছরে সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে ভর করে দেশের নির্মাণ খাতের আকার দ্বিগুণ হয়েছে। নির্মাণ খাতের অব্যাহত প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় গত দুই দশকে দেশে নির্মাণসামগ্রীর বাজারও সম্প্রসারিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। এরমধ্যে রড, সিমেন্ট, সিরামিক ও রঙে গড়ে উঠেছে বৃহৎ শিল্প। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে রড, সিমেন্ট ও সিরামিক। সিরামিক টাইলস ও রং আমদানি হলেও রড ও সিমেন্টে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সম্ভাবনা থাকায় খাত দুটিতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। নতুন বিনিয়োগও হচ্ছে। আসছে বিদেশী বিনিয়োগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণ খাতের আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রড ও সিমেন্টের উৎপাদনও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত দশ বছরে সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে ভর করে দেশের নির্মাণ খাতের আকার দ্বিগুণ হয়েছে। সেই চাহিদা মেটাতে দেশে গড়ে উঠেছে ৩০০টির বেশি রি-রোলিং মিল। বছরে ন্যূনতম ১০ হাজার মেট্রিক টন রড উৎপাদন করে এমন কারখানার সংখ্যা ৫২। এসব কারখানাই ৯৮ শতাংশ রড উৎপাদন করে। এর বাইরে ফ্ল্যাট স্টিল বা ঢেউটিনসহ পাত উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানা রয়েছে। ইস্পাত খাতে ছোট ও সনাতনী কারখানার সংখ্যাও অনেক। গতবছর এ হিসাবে রডসহ ইস্পাতপণ্য বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার। মূলত বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির কারণে দেশের প্রতিষ্ঠিত ও বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ এ খাতের ব্যবসায়ে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করেছে। এসব শিল্প গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আবুল খায়ের, বসুন্ধরা, বিএসআরএম, আরএসআরএম, কেএসআরএম, ক্রাউন, জিপিএইচ ইত্যাদি অন্যতম। ইস্পাত শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে ইস্পাত শিল্পের বাজারের আকার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ্যাসোসিয়েশনের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪০টি। বর্তমানে দেশের ইস্পাত খাতের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ লাখ টন। এর মধ্যে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে ৫৫ লাখ টন। যদিও করোনার কারণে তা ৩০-৩৫ লাখ টনে নেমে এসেছে। এ খাতে উদ্যোক্তাদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, দেশের ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবার শীর্ষে রয়েছে আবুল খায়ের গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির আবুল খায়ের স্টিল বা একেএস এখন ইস্পাতের বাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১৪ লাখ টন। এছাড়া বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (বিএসআরএম) বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা সাত লাখ টন। বিএসআরএমের আরেকটি ইউনিটে বিলেট উৎপাদন করা হয়, যেটির উৎপাদন সক্ষমতা বছরে দেড় লাখ টন। এ গ্রুপের আরেকটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা সাত লাখ টন। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও কার্যক্রম রয়েছে বিএসআরএমের। হংকংয়ে গ্রুপটির একটি সাবসিডিয়ারি রয়েছে। কেনিয়ায়ও বিএসআরএম বিনিয়োগ করেছে। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারতের কলকাতায়ও কয়েক বছর ধরে ব্যবসা করছে বিএসআরএম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসআরএম গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) এবং কোম্পানি সচিব শেখর রঞ্জন কর বলেন, অগ্রিম আয়করসহ বিভিন্ন ধরনের করের চাপে করোনার আগে থেকেই দেশের ইস্পাত শিল্প ব্যবসায়িকভাবে চাপের মধ্যে ছিল। করোনার কারণে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোই ব্যবসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। ছোটদের অবস্থা তো আরও খারাপ। এভাবে চলতে থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। করছাড় সুবিধা দেয়া হলে ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। এতে করে সরকারও বেশি হারে রাজস্ব পাবে। দেশের ইস্পাত শিল্পে ১৯৮৪ সালে যাত্রা করে কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (কেএসআরএম)। বর্তমানে বছরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সক্ষমতা আট লাখ টন। ১৯৭৮ সাল থেকে দেশের ইস্পাত শিল্পের ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে আনোয়ার গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক ৩ লাখ ৬০ হাজার টন সিমেন্ট উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। চট্টগ্রামের মিরেরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা ইস্পাত জায়ান্ট কুনমিং আয়রন এ্যান্ড স্টিল হোল্ডিং কোম্পানি বার্ষিক ২০ লাখ টন সক্ষমতার কারখানা স্থাপনে ২৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। এটি দেশের উৎপাদন খাতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। এছাড়াও জাপানের সবচেয়ে বড় ইস্পাত উৎপাদক নিপ্পন স্টিল ও সুমিতমো মেটাল স্থানীয় কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রোডাক্টসের সঙ্গে যৌথউদ্যোগে কারখানা স্থাপনে ৬ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে সিমেন্টের বাজার ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে ৩৬টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। এর মধ্যে পাঁচটি বহুজাতিক। সিমেন্ট খাতের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৬ কোটি টন, যদিও ব্যবহৃত হচ্ছে সাড়ে ৩ কোটি টন। করোনার কারণে সিমেন্টের বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ৫০ শতাংশ। এ খাতে উদ্যোক্তাদের মোট বিনিয়োগ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ১৪ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে বর্তমানে সিমেন্টের বাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আবুল খায়েরের শাহ সিমেন্ট। প্রায় ১০ শতাংশ মার্কেট শেয়ারের ভিত্তিতে সিমেন্টের বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড। বর্তমানে কোম্পানিটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৪২ লাখ টন। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ভারতের মেঘালয়ে স্থাপনকৃত লাইমস্টোন প্ল্যান্টের বার্ষিক সক্ষমতা ৫০ লাখ টন। ২০ বছর ধরে দেশের সিমেন্ট খাতে ব্যবসা করছে বসুন্ধরা সিমেন্ট। কোম্পানিটির মার্কেট শেয়ার ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। বছরে ৫০ লাখ ৫০ হাজার টন সিমেন্ট উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তাছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের তালিকাভুক্ত সিমেন্ট কোম্পানি মেঘনা সিমেন্টের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৯ লাখ টন। সিমেন্টের বাজারে কোম্পানিটির মার্কেট শেয়ার ৩ শতাংশ। ৮ দশমিক ১০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে সিমেন্টের বাজারে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বহুজাতিক সেভেন রিংস সিমেন্ট। সেভেন রিংসের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩৫ লাখ টন। আরেক বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গের দখলে রয়েছে সিমেন্টের বাজারের প্রায় ৬ শতাংশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা বার্ষিক ২৮ লাখ ৫০ হাজার টন। ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিএমএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বিএসএমএর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মেট্রোসেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শহীদুল্লাহ বলেন, দেশে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পের মোট সক্ষমতার অর্ধেকই অব্যবহৃত থাকছে। করোনার কারণে চাহিদা আরও কমেছে। দেশে নির্মাণ খাতের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ভবিষ্যতে রড ও সিমেন্টে চাহিদা আরও বাড়বে। তবে বিদ্যমান যে সক্ষমতা রয়েছে তা দিয়ে আগামী ২০-২৫ বছর চাহিদা মেটানো সম্ভব। একসময় রড ও সিমেন্ট আমদানি করা লাগলেও বর্তমানে আমরা এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে সমস্যা হচ্ছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ইস্পাত ও সিমেন্ট খাতে ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়করকে অসমন্বয়যোগ্য করা হয়েছে। এরপর থেকেই খাতদুটির উদ্যোক্তারা লোকসান গুনছেন। যদিও গত বছর এটি কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে কিন্তু এটিও অসমন্বয়যোগ্য। অথচ এর আগে আমরা অগ্রিম আয়কর দিলেও সেটি ছিল সমন্বয়যোগ্য। তাছাড়া সিমেন্টের কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় এবং কয়েক বছর ধরেই কাঁচামালের মূল্য উর্ধমুখী। এটিও এ খাতের উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এদিকে করোনার কারণে এ বছরের এপ্রিল থেকে ইস্পাত শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে এবং সঙ্কটও তৈরি হয়েছে। তাছাড়া আংশিকভাবে কেউ কেউ পেলেও এখনও পর্যন্ত সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পের সব উদ্যোক্তারা পাননি। দেশের তৈজসপত্র, স্যানিটারি ও টাইলস এই তিন ধরনের সিরামিক পণ্যের দেশীয় চাহিদার বড় অংশই বর্তমানে পূরণ করতে পারছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। নতুন বিনিয়োগও আসছে। উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিরামিক পণ্যের আমদানি কমছে। অন্যদিকে রফতানিও হচ্ছে। সব মিলিয়ে সিরামিক খাতে শক্ত ভিত তৈরি করে নিচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতি (বিসিএমইএ) জানায়, সিরামিক খাতে বর্তমানে ৬৬টি প্রতিষ্ঠান আছে। তার মধ্যে টাইলসের কারখানা ২৮টি। তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৭৫ কোটি ডলার। বাড়ি নির্মাণে আরেক প্রয়োজনীয় ‘রং’ উৎপাদনেও দেশ বর্তমানে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। রঙের বাজার সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার। প্রতিবছর রঙের ব্যবসা ৬-৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যাসোসিয়েশন জানায়, রং উৎপাদনে দেশে কোম্পানির সংখ্যা ৩৪। তার মধ্যে বিদেশী প্রতিষ্ঠান ৮টি। রঙের ব্যবসার ৮০ শতাংশই বিদেশী কোম্পানিগুলোর দখলে। তার মধ্যে বার্জার ৫০ শতাংশের বেশি ও এশিয়ান পেইন্টস ১৭ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। পরের অবস্থানে আছে রক্সি, আরএকে, এলিট, নিপ্পনসহ কয়েকটি কোম্পানি। জানতে চাইলে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী জনকন্ঠকে বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়লেও জমির উচ্চ মূল্যের কারণের ফ্ল্যাটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। তাই আবাসন ব্যবসায় কয়েক বছর ধরে মন্দাভাব যাচ্ছে। সে কারণে রঙের ব্যবসা সেই হারে বাড়ছে না। তবে সরকার পর্যায়ে স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল এবং উপজেলা পর্যায়ে পাকা বাড়িঘর নির্মাণ হওয়ার কারণে রঙের ব্যবসায় ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আছে।
×