ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মৃত্যু ৫২ শতাংশ

অন্য দেশের তুলনায় করোনায় এদেশে মৃত্যুহার কম

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ২৮ অক্টোবর ২০২০

অন্য দেশের তুলনায় করোনায় এদেশে মৃত্যুহার কম

নিখিল মানখিন ॥ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও তরুণেরা একেবারে আশঙ্কামুক্ত নয়। করোনার পাশাপাশি অন্য রোগে আক্রান্ত ও বয়স্ক ব্যক্তিরা এই রোগে মারা যাচ্ছেন বেশি। করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের অন্য সব দেশেও একই চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের করোনায় মৃত্যুর হার মোট মৃত্যুর ৫২ শতাংশ। তবে অন্য দেশের তুলনায় এদেশে মৃত্যুর হার কম। করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত সারা বিশ্ব। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। আর আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হচ্ছে আকাশচুম্বী। এই লাশের মিছিলে কারা বেশি যুক্ত হচ্ছেন তা নিয়ে মানুষের কৌতূহল অনেক বেশি। কোন বয়সী মারা যাচ্ছে বেশি, নারী নাকি পুরুষ বেশি মারা যাচ্ছে, কারা মারা যাচ্ছে ইত্যাদি জানতে চান অনেকেই। সম্প্রতি এক তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে করোনায় কারা বেশি মারা যাচ্ছেন এবং কারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত করোনায় যারা মারা গেছেন, তাদের বয়স বিশ্লেষণে, শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে ২৯ জন, যা মোট মৃত্যুর শূন্য ৫০ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ৪৬ জন, যা শূন্য ৭৯ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ১৩২ জন, যা ২ দশমিক ২৬ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৩২২ জন, যা ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৭২৫ জন, যা ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১৫৪৭ জন, যা ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৩০৩৭ জন, যা ৫২ শতাংশ। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত টেলিহেলথ সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনির জটিলতাসহ অন্যান্য কো-মরবিডিটি (সহরোগ) রয়েছে এমন কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে দেড় মাসে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছে, তাদের ৬৬ শতাংশেরই ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের মতো কো-মরবিডিটি ছিল। মারা যাওয়া ৮৪৫ জনের কো-মরবিডিটি স্ট্যাটাস বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ বিশ্লেষণ করতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করেছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর ছাড়াও রয়েছে ক্যাবিনেট ডিভিশন, আইসিটি ডিভিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পরিচালিত এ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই), বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস (বেসিস), ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) ও সিনেসিস আইটি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের জটিলতায় ভুগছিল ৩৮ শতাংশ। ২৮ শতাংশ রোগীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা ছিল। এরপর তৃতীয় সর্বোচ্চ হার্টের রোগে ভুগছিল ১১ শতাংশ। এছাড়া ৮ শতাংশ কিডনি রোগে, ৩ শতাংশ করে স্ট্রোক ও এ্যাজমা রোগের জটিলতায় ভুগে মারা গেছে। ৯ শতাংশ মৃত্যুবরণকারীর মধ্যে অন্যান্য রোগের লক্ষণ ছিল। তথ্য বিশ্লেষণে তালিকাভুক্ত যে ৮৪৫ জনের কো-মরবিডিটি স্ট্যাটাস বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সত্তরোর্ধ বয়সী রোগী ছিল ২২ শতাংশ। ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে রোগী ছিল ২৭ শতাংশ। ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে বয়স এমন রোগীর সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ। এছাড়া শূন্য থেকে ৪০ বছরের মধ্যে রোগী ছিল ১০ শতাংশের নিচে। আন্তর্জাতিক জরিপ ও গবেষণা ॥ আন্তর্জাতিক কয়েকটি প্রতিবেদনেও করোনা রোগীর মৃত্যুর পেছনে বয়স ও কো-মরবিডিটির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। করোনায় অন্যতম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইতালিতে দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশই আগে থেকে অন্য রোগে ভুগছিলেন। কাজেই যে কোন বয়সী অসুস্থ ব্যক্তিরাও ঝুঁকিতে রয়েছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে তরুণদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন উন্নত দেশের রাষ্ট্রগুলো। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর প্রচার হয় যে তরুণ ও শিশু-কিশোররা এই রোগে আক্রান্ত হয় না। মূল ঝুঁকি ৪০-এর বেশি বয়সী মানুষ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, তরুণেরাও এই ভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছেন। অন্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই রোগে মারা যাচ্ছেন বেশি। ইতালির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত যারা মারা গেছেন, তাদের ৯০ শতাংশ আগে থেকেই অন্য রোগে ভুগছিলেন। ৭৫ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিলেন। ইতালির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসেবে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশের অন্য কোন রোগ ছিল না। ২৫ দশমিক ১ শতাংশ একটি রোগে, ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ দুটি রোগে, ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ তিনটি রোগে ভুগছিলেন, যাদের ৭৫ শতাংশ হৃদ্রোগে ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল থেকে দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের ওপরে একটি জরিপ করেছে। এত দিন ধারণা করা হচ্ছিল, তরুণদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু জরিপে বেরিয়েছে যে, এমন ধারণা ঠিক নয়। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হওয়া এসব তরুণের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার কম ॥ অপ্রিয় হলেও সত্য দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পাশাপাশি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যেভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে তা বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলার সাফল্যের প্রশংসা করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকও। করোনা নিয়ন্ত্রণে ‘ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে অপরিচিত ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছেন তা সবার কাছে প্রশংসিত। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার অনেক কম। বিশ্বের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সংক্রান্ত নানা তথ্য প্রদানকারী এ ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান অনুসারে, করোনায় বিশ্বব্যাপী গড় মৃত্যুর হার ৪ শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের সফলতা ॥ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনা নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের পেছনের সঠিক কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত না হলেও তাদের মতে, জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, মানুষের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বিস্তৃত টিকাদান ব্যবস্থাসহ এ ধরনের বিভিন্ন কারণে এখানকার মানুষ করোনাভাইরাস থেকে নিজেদের সুরক্ষা করার পাশাপাশি দ্রুত সুস্থও হয়ে উঠতে পারছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যথোপযুক্ত পদক্ষেপ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দৃঢ়তার সঙ্গে সেগুলো বাস্তবায়ন করে স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে চিকিৎসাসেবাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টাকে সাফল্য হিসেবে দেখছেন অনেকেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। করোনা সঙ্কটের শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেই বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই সংক্রমণ থেকে কিছুটা ভাল অবস্থানে আছে। তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটা ভাল অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সে কারণেই পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশের পরিস্থিতি এখনও অনেকটা ভাল। করোনা মোকাবেলায় সাফল্য প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী পদক্ষেপে করোনায় মোকাবেলায় বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় সফলতার পরিমাণ বেশি। দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা থামাতে এবং করোনামুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। জনবহুল দেশ হওয়ার পরও অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার অনেক কম উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজিস্ট ও সাবেক ভিসি প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেছেন, আমরা এর পেছনের সঠিক কোন কারণ বলতে পারছি না। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। তবে আমি মনে করি, মূলত দুটি কারণ রয়েছে- জনতাত্ত্বিক এবং শারীরবৃত্তীয়। তিনি বলেন, করোনায় মৃত্যুর হার কেবল বাংলাদেশে নয়, আফ্রিকাসহ অন্যান্য দেশেও খুব কম। কারণ তাদের জনসংখ্যার বেশির ভাগই তরুণ। তরুণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে এবং তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারে উল্লেখ করে প্রফেসর নজরুল বলেন, আমাদের ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের জনসংখ্যা রয়েছে ১০ শতাংশেরও কম। তবে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। তাই আমরা বলতে পারি যে করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্রদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী মনে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না যে বাংলাদেশে করোনার মৃত্যুর হার কেন এত কম। তবে অনুমান করতে পারি, অন্যান্য আক্রান্ত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের তীব্রতা কম। তথ্য যাচাই করলে দেখা যায়, যাদের শরীরে অন্য কোন জটিল রোগ রয়েছে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন এবং যাদের সে ধরনের সমস্যা নেই তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
×