ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শিলাইদহে বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য পদ্মা বোট ডুবে গেছে

প্রকাশিত: ২১:৪০, ১৯ অক্টোবর ২০২০

শিলাইদহে বিশ্বকবির স্মৃতিধন্য পদ্মা বোট ডুবে গেছে

এম এ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ অযতœ, অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে শিলাইদহে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিমাখা ‘পদ্মা বোট’টি ডুবে গেছে। একসময় প্রমত্তা পদ্মা নদীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। সেসময় পদ্মার বুকে পাল তোলা নৌকা, একটু দূরেই গড়াই নদীর সৌন্দর্য তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। পদ্মাকে নিয়ে কবি বলেছেন, ‘বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড় ভালোবাসি। ওর পিঠে এবং কাঁধে হাত বুলিয়ে ওকে আমার আদর করতে ইচ্ছে করে’। কবিগুরুর যখন ভরা যৌবন এবং কাব্য সৃষ্টির প্রকৃষ্ট সময়; তখনই তিনি বিচরণ করেছেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। জমিদারির কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে এ সময় তিনি কখনও স্বল্প সময়, কখনও দীর্ঘ সময় অবস্থান করেছেন এখানে। ঘুরে বেরিয়েছেন ‘পদ্মা বোট’ নামের নৌকা বা ‘বজরায়’। কিংবা পালকিতে। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে এসে প্রায় বজরায় চেপে সপরিবারে পদ্মা ভ্রমণ করতেন। যে বজরাটিতে চড়ে তিনি ভ্রমণ করতেন; তার নাম ছিল ‘পদ্মা বোট’। তাঁর এ রকম আরও তিনটি বড় নৌকা ছিল। এগুলোর নাম ছিল ‘লালডিঙ্গি’, ‘চপলা’ ও ‘চঞ্চলা’। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল ‘পদ্মা বোট’। তবে এসব বজরা বা বোটের এখন কোন অস্তিত্ব নেই। এ নৌকায় চড়ে ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন তার অমর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনার তরী’। এছাড়া তিনি অসংখ্য সাহিত্য রচনা করেন ওই নৌকায় নদীর বুকে ঘুরে ঘুরে। শুধু পদ্মা নয়। ইছামতী, গড়াই, আত্রাই ও নাগরসহ নদীকেন্দ্রিক গ্রামবাংলার নিসর্গ- সৌন্দর্য্য ও শৈল্পিক বর্ণনা আছে তাঁর ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে। বিশ্বকবি এসব নদীতেও ঘুরে বেড়াতেন নৌকা বা বজরায় চেপে। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়নি সেই নৌকাগুলো। তাই কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে কবির স্মৃতিমাখা সেই বজরা বা বোটগুলো। রবীন্দ্রনাথের সেই নৌকাগুলো কেমন ছিল? তা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের জানার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। পর্যটকদের সেই আগ্রহ থেকেই ‘পদ্মা বোট’র আদলে কবির স্মৃতিধন্য শিলাইদহে বিশাল একটি নৌকা তৈরি করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে মিয়ানমার প্রজাতির চাম্বল কাঠের ৬০ ফুট দীর্ঘ ও ১৫ ফুট প্রস্থের বিশাল এ বজরাটি কবির সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তৈরি করা হয়। ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে নৌকাটি পানিতে ভাসানো হয়। তবে পদ্মার বুকে নয়; ভাসানো হয় শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির ঐতিহাসিক বকুলতলার শান বাঁধানো পুকুরঘাটে। ‘পদ্মা বোট’র আদলে তৈরি বিশেষ এই বজরাটি রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও স্মৃতি বহন করে আসছিল ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ২০১৩ সালের ৫ মার্চ বিকেলে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য কুঠিবাড়ি পরিদর্শন করেন। এসময় প্রণব মুখার্জী কুঠিবাড়িতে রক্ষিত কবির স্মৃতিসমূহ ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং বকুলতলা শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের পাশে বকুল গাছের একটি চারাও রোপণ করেন। পরে তিনি উঠে বসেন পুকুরে ভাসমান ‘পদ্মা বোট’র আদলে তৈরি বিশেষ এই বজরায়। সেখানে ভারতীয় রাষ্ট্রপতির সম্মানে শোনানো হয়, এই পুকুর ঘাটে বসে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানটি। তিনি গানটি শুনে মুগ্ধ হন। পদ্মা বোটের আদলে তৈরি বিশাল এ নৌকাটি দেখতে প্রতিদিন দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভিড় জমতো শিলাইদহে বকুলতলার পুকুরঘাটে। কিন্তু অযতœ আর অবহেলায় ‘পদ্মা বোট’র আদলে তৈরি বিশাল এই ‘বজরা’ নৌকাটি তার জৌলুস হারিয়ে বর্তমানে ডুবে রয়েছে কুঠিবাড়ির পুকুরঘাটে। গত ১৬ অক্টোবর সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় নৌকাটি পানিতে অর্ধনিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে।
×