ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে ভেল-এর ভেল্কিবাজি

প্রকাশিত: ২৩:১২, ১৮ অক্টোবর ২০২০

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে ভেল-এর ভেল্কিবাজি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে ভারত হেবি ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেডের (ভেল) ভেল্কিবাজির অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার সময়সীমা এখন পর্যন্ত ১১ মাস পিছিয়েছে ভেলের কারণেই। দফায় দফায় তাগাদা দেয়ার পরও সময়মতো কাজ না করা আবার তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে কাজ করিয়ে বিল পরিশোধ না করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে এই নির্মাণ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। চীনের সঙ্গে যৌথভাবে কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৪ সালে। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের দুটি ইউনিট এর মধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। অন্যদিকে ২০১০ সালে নেয়া রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে সময় লাগছে ১২ বছর। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার লিমিটেড (এনটিপিসি) রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের সমান অংশীদার। বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি (বিআইএফসিএল) সূত্র বলছে, ভেলের নির্মাণ গাফিলতির কারণে কেন্দ্রটি আগে থেকেই পাঁচ মাস পিছিয়ে ছিল এখন করোনার কারণে আরও ছয় মাস পিছিয়ে গেছে। ফলে ২০২২ সালের আগে কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসছে না। নতুন করে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেন্দ্রটির ২০২১ সালের শুরুতেই উৎপাদনে আসার কথা ছিল। নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে ভেলের গাফিলতি রয়েছে উল্লেখ করে বিআইএফসিএল-এর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্য ঠিকাদাররা যেভাবে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কাজ করে ভেল সেখানে একেবারেই উল্টো। ভেলকে তাগাদা না দিলে কোন কাজই হয় না। ভেলের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সিএমডি) ড. নলিন শিংহলের কাছে এ বিষয়ে জানার জন্য মেল করা হলে তিনি কোন উত্তর দেননি। গত বুধবার ভেল সিএমডির কাছে কাজে গাফিলতি এবং সাব কন্ট্রাকটারদের বিল আটকে রাখা সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি এর কোন জবাব দেননি। বিআইএফসিএল’এর একজন কর্মকর্তা বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণে মার্চের শুরু থেকেই কেন্দ্রটির নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। টানা ছয় মাসের মতো এই কাজ বন্ধ ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় কাজ শুরু হয়েছে। কতভাগ অগ্রগতি হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, করোনার আগে যে ৫০ ভাগ কাজ হয়েছিল এখনও সেখানেই আটকে আছে। এখন সাইটে ছয় হাজার দেশী-বিদেশী শ্রমিক কাজ করছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০২০ সালে আর কেন্দ্রটি যদি উৎপাদনে আসে ২০২২ সালে তাহলে পাক্কা ১২ বছর লাগবে কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসতে। উদ্যোগ নেয়ার প্রথম দুই বছর শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমিত ছিল কেন্দ্র নির্মাণের সব আয়োজন। বিআইএফসিএল সূত্র বলছে, ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর নির্মাণকারী কোম্পানিটির রেজিস্ট্রেশন হয়। সেই হিসেবেও কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসতে লেগে যাচ্ছে নয় বছর। যেখানে কোন ক্রমেই এ ধরনের কেন্দ্র নির্মাণে সাড়ে চার বছরের বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ নির্মাণ কাজ শেষ হতে প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগানো হচ্ছে। তুলেছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক ঠিকাদার কোম্পানি ডিজিজিসিএল। কোম্পানিটি অভিযোগ করছে কাজ করিয়ে ভেল বিল পরিশোধ না করা নিয়ে টালবাহানা করছে। এসব নিয়ে ঢাকা-দিল্লী পর্যন্ত সমঝোতা বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর এখন ডিজিজিসিএলের কর্মীদের প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ভারতীয় ঋণে নির্মাণাধীন কেন্দ্রের ঠিকাদার ভারতীয় কোম্পানি ভেল। টার্ন কি শর্তে কেন্দ্রটি নির্মাণ করায় নির্মাণ পর্যায়ের সব দায়িত্বই ভেলকে বহন করতে হবে। পুরো কাজটি পাওয়ার পর ভেল আবার সাবকন্ট্রাকটার নিয়োগ করে কাজ দিয়ে থাকে। সাবকন্ট্রাকটারের বিল দেয়াসহ অন্যসব দায়িত্ব ভেলকে বহন করতে হবে। অর্থাৎ বিআইএফপিসিএল নির্মাণ চুক্তির সমুদয় অর্থ ভেলকে প্রদান করবে এবার ভেল সেখান থেকে সব ধরনের নির্মাণ ব্যয় মেটাবে। কিন্তু সেই কাজটি করতে গিয়ে ভেল অনেকটা ভেল্কিবাজি শুরু করেছে। সাবকন্ট্রাকটারদের দিয়ে কাজ করিয়ে টাকা না দেয়ার অভিযোগ তুলেছে ডিজিজিসিএলের বিরুদ্ধে। ডিজিজিসিএল বলছে, ভেল ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাদেরকে (ডিজিজিসিএল) চার কোটি ৪৬ লাখ ৪০ হাজার ৩৯৮ ডলারের চারটি কাজ দেয়। কিন্তু কাজ দেয়ার শুরু থেকেই ভেল চরম অসহযোগিতা করছে। এতে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ডিজিজিসিএল তাদের অভিযোগে বলেছে, কার্যাদেশ পাওয়ার পর তারা প্রকল্প এলাকায় যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং রেডিমিক্স এবং কনক্রিট সরবরাহ শুরু করে। কিন্তু ভেল ক্রয় আদেশ দেয় পাঁচ মাস পর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ক্রয় আদেশ না পাওয়াতে ডিজিজিসিএল ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান এবং কাঁচামালের সরবরাহ আদেশ দিতে ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে সিকিউরিটি ডিপোজিট, এসডি এবং ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার সামাধান করতে দেরি করায় প্রকল্পটি ছেড়ে দিতেও পারেনি ডিজিজিসিএল। সম্প্রতি ভারতের কিছু পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে তাদের দেশের প্রকল্পগুলোর কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। এতে বাংলাদেশকে এককভাবে দায়ী করে ভারতীয় গণমাধ্যম। তবে ভেলের এই কর্মকা- বলছে প্রকল্পগুলো পেছানোর জন্য ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো এককভাবে দায়ী। বরং যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়াতে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, আগামী ২৭ অক্টোবর ভেলের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছেন। রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ অগ্রগতি তদারকি করতে প্রতিনিধি দল রামপালে যাবে বলে জানা গেছে।
×