ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর শোক

এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আর নেই

প্রকাশিত: ২২:১১, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আর নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেল ও বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাহবুবে আলম (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। রবিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী বিনতা মাহবুব, তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে সুমন মাহবুব ও মেয়ে শিশির কনাকে রেখে গেছেন। মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মৎস্য ও পানি সম্পদমন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউর রহমান শোক জানিয়েছেন। এছাড়াও শোক জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক নজিবুল্লাহ হিরু, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহম্মেদ ও খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মন্ডলীর চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা পান্না কায়সার, সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা। মাহবুবে আলম করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভোরে হার্ট এ্যাটাক হলে মাহবুবে আলমকে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার হৃদযন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না বলে জানান চিকিৎসকরা। তবে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে আগের তুলনায় তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটতে শুরু করে। পরে গত ২০ সেপ্টেম্বর তার করোনা নেগেটিভ আসে। তবে এরপর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং একই সঙ্গে পদাধিকারবলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য সংবিধানের ৫ম, ৭ম ও ১৩তম, ১৬তম সংশোধনী মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মোঃ কামরুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাপিলেট ডিভিশনে মামলা পরিচালনা করেছেন। হাইকোর্ট ডিভিশনে বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তিনি এক মেয়াদে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং এক মেয়াদে সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাহবুবে আলমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৬৯ সালে লোক প্রশাসনে ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রী নেন তিনি। ছাত্র জীবনে বাম আন্দোলনে যুক্ত মাহবুবে আলম পরে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তির পর রাজনীতি ছেড়ে আইন পেশায় পুরোদমে সক্রিয় হন মাহবুবে আলম। তিনি ১৯৭৩ সালেই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত হয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। ১৯৭৫ সালে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এবং ১৯৮০ সালে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আইন পেশা পরিচালনার অনুমতি পান। ১৯৯৮ সালে আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ১৯৯৩-৯৪ সালে তিনি সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালের ১৫ নবেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবে আলম। ২০০৭ সালে দেশে জরুরী অবস্থা জারির আগে সুপ্রীমকোর্র্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন মাহবুবে আলম। সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই সরকার আমলে শেখ হাসিনা গ্রেফতর হওয়ার পর শীর্ষ আইনজীবীদের অনেকে পিছুটান দিলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাহবুবে আলম। দৃশ্যত সেই কারণেই তার উপর আস্থাবান ছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান মাহবুবে আলম। তার পর থেকে টানা ১১ বছর তিনি এ দায়িত্বে বহাল ছিলেন। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মাহবুবে আলম। তবে তাকে প্রার্থী না করে এ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বই চালিয়ে যেতে বলা হয়। মাহবুবে আলম ১৯৭৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লীর ‘ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিশনাল এ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্ট্রাডিজ’ থেকে সাংবিধানিক আইন ও সংসদীয় প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেন। ভ্রমণপ্রিয় হিসেবে পরিচিত এই আইনজীবী দেশে ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে বিভিন্ন সময় ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, হংকং, কোরিয়া ও তানজানিয়াসহ অনেক দেশ সফর করেছেন। রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী মাহবুবে আলমের স্ত্রী বিনতা মাহবুব একজন চিত্রশিল্পী। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে সুমন মাহবুব দীর্ঘদিন সাংবাদিকতায় ছিলেন, মেয়ে শিশির কনা আইন পেশায় রয়েছেন। রাষ্ট্রপতির শোক ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এ্যাটর্নি জেনারেল এ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। আজ এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, মরহুম মাহবুবে আলম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির যোদ্ধা। তার মৃত্যু বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। রাষ্ট্রপতি মাহবুবে আলমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনিয়র আইনজীবী মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি আজ এক শোক বার্তায় বলেন, দেশের আইন অঙ্গনে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মাহবুবে আলমের অবদান জাতি সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘তিনি একজন প্রথিতযশা আইনজীবী হিসেবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক আইনী বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভূমিকা রেখেছেন এবং সব সময় ন্যায়নিষ্ঠ থেকে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া এ্যাটর্নি জেনারেলের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান এমপি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। আজ জানাজা, দাফন বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ॥ বাংলাদেশের এ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মাহবুবে আলমের জানাজা আজ সোমবার সুপ্রীমকোর্টে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে। রবিবার রাতে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আগামীকাল সোমবার বেলা ১১টায় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মরদেহ সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে আনা হবে। আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে তাকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
×