ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কুকুর নিধন কিংবা অপসারণ করবে না উত্তর সিটি

প্রকাশিত: ২৩:০৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

কুকুর নিধন কিংবা অপসারণ করবে না উত্তর সিটি

মশিউর রহমান খান ॥ কুকুর নিধন বা অপসারণ না করে কুকুরকে টিকা প্রদান ও বন্ধ্যাকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। একইসঙ্গে সংস্থাটি তার সীমানায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কুকুর বা যে কোন প্রাণী অপসারণ কিংবা ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলে জানতে পারলে ২০১৯-এর আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন সংস্থাটির মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম। চলতি মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাসের প্রথম দিকে এ কার্যক্রম শুরু করবে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) রাজধানী থেকে কুকুর অপসারণের উদ্যোগ নেয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার মধ্যে এই পথ থেকে সরে এসেছে ডিএনসিসি। মহাখালীর জাতীয় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে কুকুরের কামড়ে ঢাকায় অন্তত ৮ হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার এ পরিসংখ্যান আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এর ফলে এদের মাধ্যমে মানবদেহে ছড়াচ্ছে র‌্যাবিস, টক্সো প্লাজমোসিস ও কালাজ্বরের মতো ভয়াবহ রোগের জীবাণু। এ পরিস্থিতির জন্য বাসিন্দারা ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও তাদের সহযোগী এনজিও অভয়ারণ্যকে দায়ী করতে দেখা গেছে। জানা গেছে, কুকুরের উপদ্রব কমাতে ডিএসসিসি একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৪০০ মেয়ে কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ ও ৪০০ পুরুষ কুকুরকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে ও পর্যায়ক্রমে অন্য কুকুরকেও এ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ২০১২ সালে উচ্চ আদালত কুকুর নিধনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারির পর ওই বছরের মার্চ মাসে অভয়ারণ্য নামে ওই বেসরকারী সংস্থার (এনজিও) সঙ্গে চুক্তি করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। ওই বছর ১ এপ্রিল থেকে তারা কার্যক্রম শুরু করে। চুক্তিতে শর্তানুযায়ী বেওয়ারিশ কুকুর নিধন না করে বন্ধ্যাকরণ এবং টিকাদানের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কুকুর নিয়ন্ত্রণ করবে। চুক্তি অনুযায়ী, রাজধানীর রাস্তাঘাট থেকে কুকুরের বংশবিস্তার রোধে বেওয়ারিশ কুকুরগুলো উত্তর সিটির বসিলা এলাকায় অভয়ারণ্যের নিজস্ব ক্লিনিকে নিয়ে বন্ধ্যা করে ছেড়ে দেবে। তাই এ কাজের জন্য অভয়ারণ্যকে বিনামূল্যে ওষুধ, যন্ত্রপাতি এবং অর্থ প্রদান করে সরকার। এ বাবদ দুই সিটি করপোরেশন দৈনিক খরচের ভিত্তিতে প্রতিমাসে অভয়ারণ্যকে ৮০ হাজার টাকা করে দেয়া হতো বলে জানা গেছে। পরে চুক্তি শেষ হওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলিসহ সর্বত্রই বেড়েছে কুকুরের যন্ত্রণা। দিন কি রাত এই কুকুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। সংঘবদ্ধ কুকুরের দলের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে অনেকেরই রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। এসব কুকুর নিয়ন্ত্রণ বা নিধনেও নেই তেমন কোন কার্যক্রম। ফলে প্রতিনিয়তই রাজধানীতে বাড়ছে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা। সূত্র জানায়, প্রাণী কল্যাণ আইন অনুযায়ী, প্রাণী অপসারণ অপরাধ, কিন্তু সিটি কর্পোরেশন ব্যতীত এলাকার জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে সিটি কর্পোরেশনের বাইরে ব্যক্তি কিংবা সংস্থা পর্যায়ে যা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সিটি কর্পোরেশনের মৌলিক কার্যাবলি হিসেবে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন-২০০৯ এর তৃতীয় তফসিলের ১৫.৩, ১৫.৪, ১৫.৫ ও ১৫.১০ এবং পঞ্চম তাফসিলের ৫১ ধারা ও সপ্তম তফসিলের ১৮ ধারা অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশন যদি মনে করে কোন বেওয়ারিশ কুকুর অথবা কোন বেওয়ারিশ প্রাণীকে অপসারণ করতে পারে, এমনকি নিধনও করতে পারে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মনে করি, কুকুরকে স্থানান্তর করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের ২০১৯ সালের আইনে কুকুর বা বন্যপ্রাণীকে কীভাবে দেখতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আমাদের মহাখালীতে যে মার্কেট রয়েছে, সেখানে কুকুরের জন্য আমরা একটা হাসপাতাল করেছি। আমি নিজেও করোনার সময় বিভিন্ন স্থানে কুকুরকে খাবার দিয়েছি। আমি এখনও তাদের জন্য খাবার পাঠাচ্ছি। মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনানুযায়ী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কুকুর আমাদের অনেকের বাসাবাড়ি ও রাস্তার সামনে পাহারায় থাকে ও তারা পরিবেশের ব্যালেন্স রক্ষা করে। ইঁদুরসহ ক্ষতিকর অনেক প্রাণী মেরে ফেলে। অনেক অপরিষ্কার জায়গাকে পরিষ্কার করে। আবার অপরিষ্কারও করে। আমি যেটা মনে করি, কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করতে হবে। তাদের জলাতঙ্কের ইনজেকশন দিতে হবে। মেয়র বলেন, ডিএনসিসির বেসরকারী সংস্থা ‘অভয়ারণ্যে’ ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি এলাকার সব কুকুরকে টিকা দেয়া বন্ধ্যাকরণের কাজ করত। তাদের সঙ্গে করা চুক্তির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে কুকুর বন্ধ্যাকরণের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করতে কথা বলেছি। তাদের সহায়তা নিয়ে ও এনজিও অভয়ারণ্য সংস্থার সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করি, চলতি মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাস থেকে কুকুর হত্যা বা নিধন নয় বন্ধ্যাকরণ ও নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কুকুরকে টিকা দেয়ার কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। কারণ অভয়ারণ্যের সঙ্গে যে চুক্তি ছিল সেটার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে আমরা আবারও চুক্তিতে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে বেওয়ারিশ কুকুরদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মেয়র। মেয়র আতিক নগরবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, ডিএনসিসি এলাকায় কোন কুকুর নিধন হবে না। এটি নিশ্চিত। এছাড়া কুকুরকে আমাদের অনেকেই ভালবাসেন। অনেকেই তাদের বিভিন্ন স্থানে খাবার দিচ্ছেন। কুকুরের সঙ্গে অনেকের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আমার মেসেজ খুবই স্পষ্ট। ডিএনসিসিতে কোন ধরনের কুকুর উচ্ছেদ বা অপসারণ বা ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হবে না। যদি কোন নাগরিক তা করে, তাহলে আমরা ২০১৯-এর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। তবে কাজ শুরুর পর এ নিয়ে সমস্যা হলেও প্রাণীর সুরক্ষায় বিবেচনায় নেয়া হবে। কুকুরকে বিরক্ত না করার আহ্বান জানিয়ে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, কুকুর কুকুরের জায়গায় থাকবে। আমরা আমাদের জায়গায় থাকব। তাদের নিয়েই কিন্তু আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। ২০১৯ সালের আইনেই পাস করে দেয়া হয়েছে তাতে কোন পোষা বা বেওয়ারিশ কুকুরকে কোন প্রকার ঢিল দেয়া, লাঠি দিয়ে বা অন্যভাবে আঘাত করা যাবে না। তাই বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে সকলের প্রতি মেয়র আহ্বান জানান। সূত্র জানায়, ডিএসসিসি তার আওতাধীন এলাকা থেকে কুকুর অপসারণ করছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এরইমধ্যে কয়েক শ’ কুকুরকে কর্পোরেশনের মাতুয়াইল এলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৩০ জুলাই দক্ষিণ সিটির বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে সংস্থার মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকাবাসীর অভিপ্রায় অনুযায়ী, বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। এরপর ডিএসসিসির উর্ধতন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে বলা হয়, সংস্থাটি ৩০ হাজার কুকুরকে শহরের বাইরে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা করছে। এরপরই এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পক্ষে-বিপক্ষে মানববন্ধন করাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে বেওয়ারিশ কুকুর নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই আমরা এসব কুকুরের জন্ম নিয়ন্ত্রণে কাজ করি। তবে এজন্য নির্ধারতি এনজিও অভ্যয়ারণ্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বলেন, কুকুর নিধন বা হত্যা নয় আমরা কুকুরকে টিকা দেয়া ও বন্ধ্যাকরণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সঙ্গে কিভাবে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করা যায় ও কুকুরদের রেখেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কাজ করছি। এছাড়া যে সংস্থাটি আমাদের কুকুর বন্ধ্যাকরণের কাজ করত সেটির সঙ্গে করা চুক্তির মেয়াদ ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই নতুন করে চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে।
×