ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক, নানা সিদ্ধান্ত অর্থনীতির চাকা সচল রেখে সব কাজ চলবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলাসহ সব সিদ্ধান্ত হবে অবস্থা বুঝে জাতীয় পরামর্শক কমিটির বাড়তি সতর্কতা

প্রতিরোধের প্রস্তুতি ॥ শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা

প্রকাশিত: ২২:৫২, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

প্রতিরোধের প্রস্তুতি ॥ শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে কাজ শুরু করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের প্রস্তুতি নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একবার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ ফের বেড়ে যাওয়ায় আবার হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের হিসাব অনুযায়ী পৌষ ও মাঘ দুই মাস শীতকাল। তবে আশ্বিনের শুরু থেকেই প্রকৃতি শীতের আগমনের জানান দিচ্ছে। বিশে^র শীতপ্রধান দেশগুলোতে করোনার তীব্রতা বাড়তে দেখা যায়। ঠাণ্ডায় সাধারণত জ¦র, সর্দি, কাশিসহ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা এমনিতেই বাড়ে। এর সঙ্গে করোনা যুক্ত হলে সংক্রমণ বাড়ার পাশাপাশি বাড়তে পারে মৃত্যুও। তাই আগাম সতর্ক থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে এখন সংক্রমণের চিত্র প্রায় স্থিতিশীল হলেও ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে সতর্ক করেছে কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। রবিবার কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সহিদুল্লাহর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই শঙ্কার কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দেয়া হয়। সোমবার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শীতে পরিস্থিতির অবনতির ঘটবে ধরে নিয়ে এখন থেকেই প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দেন। সংক্রমণ বাড়তে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। মার্কিন রোগতত্ত্ব ও প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠান সিডিসির প্রধান জানিয়েছেন, টিকার থেকেও করোনা রোধে মাস্ক বেশি কার্যকর। ডব্লিউএইচও হুঁশিয়ারি দিয়েছে, মহামারী ফিরছে ইউরোপে। করোনায় আক্রান্ত ৭ জনের একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। ইংল্যান্ডে রোগী বেড়েছে ১৬৭ শতাংশ। সেজন্য ফের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে করোনায় মৃত্যুহার বিশ্বে সর্বনিম্ন। দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে থাকে। জুনে সেটা তীব্র আকার ধারণ করে। শুরু থেকেই করোনা শনাক্তে টেস্টের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, যত পরীক্ষা, তত সুরক্ষা। দেশে প্রথমদিকে কেবলমাত্র রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলেও দিনে দিনে সেটি বেড়েছে এবং পরীক্ষা কেন্দ্রেরও বিস্তার ঘটেছে। তবে পরীক্ষাগারের সংখ্যা বাড়লেও গত জুন মাসের শেষে করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য সরকারীভাবে ফি নির্ধারণ, টেস্ট করাতে ভোগান্তি, রিপোর্ট পেতে দেরিসহ নানা কারণে মানুষ করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহ হারায়। ফলে টেস্টের সংখ্যা কমে আসায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জনগণকে করোনা টেস্ট করানোর জন্য একাধিকবার অনুরোধ ও আহ্বান করা হয়। তারপরও মানুষকে করোনার নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহী করানো যায়নি। একইসঙ্গে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করানোর চেষ্টায় মানুষের অবাধ চলাচল বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চিত্র খুব কমই চোখে পড়ে। ইতোমধ্যে গণপরিবহন খুলে দেয়ার পাশাপাশি সাধারণ ছুটি বাতিল করেছে সরকার। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফা দেশে করোনা সংক্রমণের ঢেউ প্রতিরোধে নানা পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। পরামর্শক কমিটির সুপারিশের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে আরও বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সবকিছু চূড়ান্ত করা হতে পারে। এছাড়াও রোগ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে তাৎক্ষণিক আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। সর্বোপরি কথা হলো করোনা চিকিৎসায় কার্যক্রম এখন চলছে। যে কারণে বাদবাকি প্রস্তুতি নিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সত্যিই কি স্বাভাবিক পরিস্থিতি ॥ সংক্রমণ আগের থেকে কমেছে। কমেছে মৃত্যুর হার। অনেকে বলছেন, নানা জটিলতার কারণে মানুষ এখন আর টেস্ট করাতে চান না। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই। ফলে হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যেসব নির্দেশকের মাধ্যমে কোন দেশের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিনা বলে বোঝা যায়, তার কোনটারই প্রতিফলন বাংলাদেশে নেই। বিশ্বের যেসব দেশে সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা ভাল ছিল সেখানে টেস্ট, ট্রেসিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা ভাল, মেনেও চলা হয়েছে। তারপরও কিছু কিছু দেশ দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণের কবলে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্দেশনাগুলো মেনে চলার হার কোনটাই পর্যাপ্ত নয়। বরং মেনে চলার প্রবণতাই নেই। যে কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে বাংলাদেশে এখনও দূরে। বরং সংক্রমণের একটা দীর্ঘস্থায়ী চক্রে পড়তে পারে বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও জানিয়েছে, বর্তমানে করোনা পরীক্ষার হার নিম্নমুখী হলেও তা নিয়ে স্বস্তির কিছু নেই। আবার দেশের সবাইকে আবশ্যিকভাবে করোনার পরীক্ষা করাতে বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অনেকেই টেস্টের ব্যাপারটিকে খুবই হেলাফেলা করছেন। টেস্ট করাচ্ছেন না, এখানে কোন ভুল করলে তার মাশুল আমাদের দিতে হবে। ফের সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মতো প্রস্তুতির পরামর্শ ॥ কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশেও পুনরায় করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। আর সেজন্য দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মতো প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করে আইসোলেশনে রাখা গেলেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এখনও করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। যারা এটা করতে পেরেছে, তারা করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে না। রোগীদের যদি শনাক্ত না করা হয়, তাদের যদি কোয়ারেন্টাইনে নেয়া না হয়, তাহলে তাদের মাধ্যমেও অন্যরা সংক্রমিত হবেন। এভাবেই রোগীর থেকে রোগী ছড়াচ্ছে। আবার যে বাসায় একজন সদস্য কোনভাবে আক্রান্ত হয়ে যায়, সে বাসায় একাধিক সদস্য সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে। এটা যদি হাসপাতালে ম্যানেজ হতো তাহলে সংক্রমণের হার কমে আসত। এসব মিলিয়ে যে অবস্থায় আছি, তাতে করে সংক্রমণ কমার কথা নয় বরং আমরা একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের মধ্যে যাচ্ছি। আমাদের দেশে একটা ওয়েভের ওপর আরেকটি ওয়েভ সুপার ইমপোজড হবে মন্তব্য করে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, তাতে করে সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হবে। একইসঙ্গে গ্রামে সংক্রমিত হচ্ছে, কিন্তু তারা শনাক্ত হচ্ছেন না।’ বিমান চালু হচ্ছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যাতায়াত বাড়ছে। দেশে যারা আসছেন, তাদের প্রকৃত কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন করা সম্ভব কিনা, কিংবা এসব হলে আদৌ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন করেন তিনি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের সামনের দিনগুলো নিয়ে সতর্ক থাকার কোন বিকল্প নেই। সবার ধারণা শীতে সংক্রমণ বাড়তে পারে। তাই সরকারের উচিত হবে সমস্যা শুরুর আগে চূড়ান্ত প্রস্তুতির। তাছাড়া প্রতিরোধে ঢিলেঢালা কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। জনস্বার্থে সবকটি সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা, রোগী শনাক্তসহ র‌্যাপিড টেস্ট নিশ্চিত করারও বিকল্প নেই বলে মনে করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ ঠেকাতে পূর্ণ জাতীয় কমিটির নানা পরামর্শ ॥ নিজেদের বৈঠকের পর করোনা প্রতিরোধে সরকারের গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণের মধ্যেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ উন্মুক্ত হচ্ছে, এটি হতেই থাকবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে আমাদের দেশেও পুনরায় সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পূর্ণ প্রস্তুতি রাখতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশে সংক্রমণের হার নিম্নমুখী হলেও ‘স্বস্তির’ জায়গায় পৌঁছেনি। কোভিড চিকিৎসায় নিবেদিত কিছু হাসপাতালে শয্যা খালি থাকছে। অন্যদিকে অন্য রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এ অবস্থায় অন্যান্য রোগের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, অর্থ সাশ্রয় করতে কোভিড-১৯ হাসপাতালের অব্যবহৃত শয্যা সংকোচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে দেশে এখনও আইসোলেশন কেন্দ্রের প্রয়োজন আছে বলে মনে করে জাতীয় পরামর্শক কমিটি। তাই শয্যা সংখ্যা সংকোচন করা হলেও পুরোপুরি বন্ধ করা ঠিক হবে না। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে যাতে পুনরায় এসব আইসোলেশন সেন্টার ব্যবহার করা যায়, সেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এখনই করণীয় বিষয় ঠিক করে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় পরামর্শক কমিটি। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ দ্রুত নির্ণয়ের জন্য আরও বেশি পরিমাণে পরীক্ষা করা প্রয়োজন জানিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ অবস্থায় কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করতে সংক্রমিত ব্যক্তিকে দ্রুত চিহ্নিত করে আইসোলেট করার বিকল্প নেই। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীর দেশে আসছে জানিয়ে ভ্রমণ সংক্রান্ত পরামর্শ ও নিয়ম জারি করার তাগিদ দিয়েছে জাতীয় পরামর্শক কমিটি। সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশে ঢোকার স্থানগুলোতে কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বিদেশ ফেরতদের স্ক্রিনিং, প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে করোনাট্রেসার এ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান ॥ আসছে শীতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যদি আবার বাড়ে, তা মোকাবেলায় এখন থেকেই সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবিবার এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে। সেজন্যই হয়ত আমরা এটা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। তবে সামনে শীত, আরেকটু হয়তো খারাপের দিকে যেতে পারে। তবুও আমাদের এখন থেকে প্রস্তুতি থাকতে হবে। ইতোমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে, যাকে ‘সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ’ বলা হচ্ছে। আগামী শীতে এ ভাইরাসের প্রকোপ ফের বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই সতর্ক করে আসছেন। রবিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা কবলেন। অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত সরকারের ॥ করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাজার ও শপিংমলের সব ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে মাস্ক না থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার। যে কোন দিন যে কোন মার্কেটে’ পর্যবেক্ষণ চালিয়ে এই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সতর্ক করেছেন। সোমবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত জানানোর সময় সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি সম্প্রতি একটি কাজে একটি মার্কেটে গিয়েছিলাম, আমি সেখানে বেশি লোককে মাস্ক পরতে দেখিনি। পরে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি, আমরা ক্রস চেক করব যে কোন দিন, সে মার্কেটে যদি সবাইকে মাস্ক পরা না দেখি তাহলে উই উইল টেইক এ্যাকশন। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত ৩ আগস্ট থেকে হাটবাজার, দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখার সময় বাড়িয়ে রাত ৮টা পর্যন্ত করেছে সরকার। হাটবাজার, দোকানপাট ও শপিংমলে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালনের পাশাপাশি শপিংমলে প্রবেশমুখে তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র এবং হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা ছাড়াও শপিংমলে আসা যানবাহনগুলোকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব নিয়ম পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাসার বাইরে সব জায়গায় সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে গত ২১ জুলাই একটি পরিপত্র জারি করা হলেও নানা অজুহাতে মানুষ তা এড়িয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মাস্ক ব্যবহার করা দরকার। সবাই মিলে ঠিকভাবে মাস্ক যদি ব্যবহার না করি তাহলে কিন্তু মুশকিল। এই মহামারীর মধ্যে যারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না- ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। মাস্কে ৯৮ ভাগ সুরক্ষা ॥ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই তরফ থেকে যদি মাস্ক পরা থাকে তাহলে ৯৫-৯৮ শতাংশ নিরাপদ। আর এক তরফ থেকে মাস্ক থাকলে ৬০-৬৫ শতাংশ নিরাপদ। মাস্ক যদি না পরে তাহলে কিন্তু কোন কিছুই সফল হবে না। এজন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কেউ মাস্ক কিনতে না পারলে বাড়িতে কাপড় দিয়ে সহজেই তা বানিয়ে নেয়া যাবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, অনেক দেশে, বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবেম্বরের শেষ থেকে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ আসতে পারে, সেই প্রস্তুতি রাখতে হবে। সেজন্য মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ডাকা হয়েছে। মৃত্যু আক্রান্ত আছেই ॥ দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার ১৯৯ দিনের মাথায় সরকারী হিসাবে মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেল। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত আরও ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাতে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৭ জন। গত একদিনে আরও ১ হাজার ৫৫৭ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাতে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ১৭৮ জনে। বিশ্বে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৩ কোটি ১৩ লাখ পেরিয়েছে; মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৯ লাখ ৬৪ হাজারে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৫তম স্থানে। তার মৃতের সংখ্যায় বাংলাদেশ রয়েছে ২৯তম অবস্থানে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১০২টি ল্যাবে ১৪ হাজার ১৬৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৪৮৭টি নমুনা। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৭৪ দশমিক ০৫ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪২ শতাংশ। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ৭-১০ দিনের মধ্যে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার নির্দেশ ॥ করোনার দ্বিতীয় পর্বের ঢেউ সামলাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মঙ্গলবার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখে করোনাভাইরাস জনিত রোগ কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ওয়েভ মোকাবেলা করতে কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করছে সরকার। শীতকালে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণের আশঙ্কায় নিয়ে সচিবালয়ে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ কথা জানান। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে এই সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ছাড়াও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিবরা অংশ নেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ মাহফুজুর রহমান, পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ সভায় উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘যদি আসে (দ্বিতীয় ওয়েভ) আমরা টোটাল প্রোগ্রামকে ভাগ করে নিলাম। ওয়ার্ক প্ল্যান রেডি করে নিতে হবে। ক্লিনিক্যাল সাইটটা আমাদের এক্সপার্টরা রেডি করবেন, যদি রোগটা বিস্তার করে কীভাবে তার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান হবে। সাপ্লিমেন্টারি ক্লিনিক্যাল সাইট, যেহেতু শীতের সময় এ্যাজমা, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি থাকবে, সেটাকেও ইমিডিয়েটলি সবাইকে সচেতন করে দেয়া এবং তারও একটা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান রেডি করা।’ মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ব্যাপক প্রোমোশনাল ক্যাম্পেন চালাতে হবে সবাই যাতে মাস্ক পরে। সবাই যাতে দূরত্বটা বজায় রাখে। স্বাস্থ্য নির্দেশিকা সবাই যাতে মেনে চলে। এনফোর্সমেন্ট সাইট মাঠ প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনী এটা কীভাবে করবে, সেই ওয়ার্ক প্ল্যান করা হবে। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে ব্যাপক লোকজন বাইরে থেকে আসছে ও যাচ্ছে। তাদের কীভাবে প্রিকোশনারিভাবে (সতর্কতা) ট্রিটমেন্ট করব যাতে বাইরে থেকে আর ভাইরাস না আসে। বিমানবন্দরে সেনাবাহিনীর বড় টিম আছে, তারা দেখাশোনা করছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা বসে সভা করে ওয়ার্কপ্ল্যান করে ওপেন করে দেব। অভিযান বাড়ানো হবে কি না- প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘না, সিনারির ওপর ডিপেন্ড করবে। যদি কোনো রকম ইমপ্যাক্ট না হয়...। আমাদের মূল কথা থাকবে আমরা ইকোনমিকে সচল রাখব ইনশাল্লাহ। ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা- প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয় সিদ্ধান্ত নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা তাদের অধিক্ষেত্রের অফিসগুলো কীভাবে চালাবে তারা সেই ব্যবস্থা নেবে। তথ্য মন্ত্রণালয় পিআইডির মাধ্যমে, স্থানীয় সরকার বিভাগ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদগুলোকে ব্যবহার করে মানুষকে আরও সচেতন করা হবে। ’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগের ইউনিয়ন পর্যন্ত কর্মচারী আছে, তারা এ বিষয়ে কাজ করবেন। গণমাধ্যমেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। ৭ থেকে ১০ দিন সময় দিয়েছি এ সময়ে তারা ওয়ার্ক প্ল্যান রেডি করবে। ’ সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখন যেটা করছি, কোলাবরেশন উইথ সিভিল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ফরেন মিনিস্ট্রির সঙ্গে, এয়ারপোর্টে এবং বিভিন্ন এন্ট্রিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন থাকে। অনেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আসে তারা কোভিড ফ্রি। যারা নিয়ে আসেননি তারা কতদিন সেখানে হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন, সেই সার্টিফিকেট নিয়ে আসেন। যাদের এ রকম কোন সার্টিফিকেট নেই এবং যাদের সন্দেহ হয় তাদের আমরা ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাই। ঢাকার দিয়াবাড়ি ও হাজী ক্যাম্পে (কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা) আছে। করোনা যখন পিকে ছিল তখন সাড়ে তিন হাজারের মতো ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারেন্টাইনের ক্যাপাসিটি ছিল। সেখানে ১৫শোর উপরে উঠে নাই। এজন্য আমরা এটাকে কমিয়ে দুই হাজারের মতো রেখেছি। এতে আমাদের সাশ্রয় হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি আবার রিভাইভ করে, সিচ্যুয়েশন খারাপ হয়ে যায় তাহলে আমরা কোয়ারেন্টাইন সুবিধা আবার সাড়ে তিন হাজারে নিয়ে যাব। যারা কোভিড ফ্রি ও ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন করে এসেছেন তাদের কোয়ারেন্টাইনে নেয়া লাগে না।’ আবার লকডাউনের মতো কোন ঘটনা ঘটছে কি না- প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আমরা ওটা (লকডাউন) এখনও চিন্তা করিনি। অনেক দেশেই বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নবেম্বরের শেষ থেকে দ্বিতীয় ওয়েভ আসে কি না সেই প্রস্তুতি রাখতে হবে। দ্বিতীয় ওয়েভ ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। বৈঠক সূত্রগুলো বলছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনা সংক্রমণ দেখা দিলে তা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সার্বিক পরিকল্পনা মধ্যে নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য সচিবকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ধাপে করোনা প্রাদুর্ভাব আসলে কোন খাতে কি ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে তা ঠিক করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত পরিকল্পনা নিতে পুলিশ প্রধানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বৈঠক থেকে। সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে এসব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়াও অর্থনীতির চাকা সচল রেখে সব ধরনের পরিকল্পনা নিতে বলা হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, দ্বিতীয় ধাপে করোনার ধাক্কা এলে পরিস্থিতি বুঝে করণীয় ঠিক করা হবে। সোমবার করোনার দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ ঠেকাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এই নির্দেশনার আলোকেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে এই বৈঠক আহ্বান করা হয়। এতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব সভাপতিত্ব করেন।
×