ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিজিবি বলছে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে

চোরাই পথে বানের পানিতে আসছে ভারতীয় গরু-মহিষ ॥ কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দুশ্চিন্তায় খামারিরা

প্রকাশিত: ২১:৪১, ২৫ জুলাই ২০২০

চোরাই পথে বানের পানিতে আসছে ভারতীয় গরু-মহিষ ॥ কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দুশ্চিন্তায় খামারিরা

ওয়াজেদ হীরা ॥ করোনা মহামারীর সময়ে ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে গবাদিপশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় খামারিরা। এ পরিস্থিতিতে তাদের ওপর আরও একটি দুশ্চিন্তা ভর করেছে। সেটা হলো- চোরাইপথে ভারত থেকে গরু আসা। গত কয়েকদিন ধরে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের স্রোতে পানিতে ভাসিয়ে প্রতিদিন শত শত ভারতীয় গরু ঢোকানো হচ্ছে বাংলাদেশে। এবার দেশে কোরবানির জন্য যে পশু প্রস্তুত করা হয়েছে, করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তারই বড় একটা অংশ অবিক্রীত থেকে যাবে। তার ওপর চোরাইপথে গরু আসলে খামারিদের কপাল পুড়বে। যদিও মন্ত্রণালয় বলছে, সীমান্ত পথে গবাদিপশুর অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রাণিস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্টেরয়েড ও হরমোন জাতীয় ওষুধ চোরাইপথে আসা বন্ধ করার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, উত্তরের বন্যা পরিস্থিতিতে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এবার ভিন্ন কৌশলে ভারত থেকে আনা হচ্ছে গরু-মহিষ। উত্তরের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় ভারতের গরু-মহিষ আনতে কারবারিরা ব্যবহার করছে বানের পানি। দেশে প্রবেশের পর কুড়িগ্রামের সীমান্ত এলাকায় গরুর হাটগুলোতে এসব গরু-মহিষ বিক্রি হচ্ছে। বন্যার কারণে বিজিবি ও বিএসএফের কাজে বিঘ্ন হওয়ায় পাচারকারীরা সুবিধা পাচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে বিজিবি বলছে, সীমান্তে নজরদারিসহ টহল জোরদার করা হয়েছে। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া ও নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে চোরাকারবারিরা বিভিন্নভাবে সীমান্তের নদীপথে গরু প্রবেশ করাচ্ছে। গরু প্রবেশের খবর পাওয়া মাত্র তা সিজ করা হচ্ছে। দেশের একাধিক খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনায় যেখানে দেশীয় গরু বিক্রি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে সেখানে ভারতীয় গরুর অনুপ্রবেশ শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। গাজীপুরের খামারি আজিজুল মিয়া বলেন, গতবার কোরবানির আগেই অনলাইনে বিক্রি করেছিলাম ১৫টি গরু আর হাটে বাকিগুলো। এবার অনলাইনে বিক্রি হলেও দাম পাচ্ছি না, হাটে কেমন বিক্রি হবে শঙ্কায় আছি। গরুর দাম এমনিতেই কম মনে হচ্ছে আবার বাহিরের গরু প্রবেশের খবর শুনছি। যদি গরু আসে আমরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। বাংলাদেশ ডেইরি ডেভলপমেন্ট ফোরামের সভাপতি এ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম এর আগে বলেছেন, আমরা কোনভাবেই চাই না যে ভারত থেকে কোরবানির পশু বাংলাদেশে আসুক। এমনিতেই এবার খামারিদের অবস্থা নাজুক। করোনায় অনেকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। অনেকেই কোরবানি দিতে পারবে না। সরকার ভারত থেকে কোন পশু আনছে না। তবে চোরাইপথে এলে সেটাকে স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়া দরকার। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এবার ঈদ-উল-আজহায় সারাদেশে খামারগুলোতে ১ কোটি ১৯ লাখ গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আর কোরবানির জন্য সর্বোচ্চ ১ কোটি ১০ লাখ গবাদিপশু দরকার হবে। অর্থাৎ সরকারী হিসাবেই চাহিদার তুলনায় ৯ লাখ গবাদিপশু বেশি। এছাড়া গত বছর কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল ১ কোটি ১৮ লাখ পশু। এর মধ্যে ১ কোটি ৬ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। সে হিসাবে গত বছরেরও ১২ লাখ পশু অবিক্রীত রয়েছে। দেশের গরু-ছাগলের খামারিদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, সরকার এবার কোরবানির হাটের যে চাহিদা নিরূপণ করেছে, তা থেকেও ২০ শতাংশ গবাদিপশু কম বিক্রি হবে। কারণ, ক্রেতাদের হাতে টাকা নেই। খামার থেকে হাটে গরু নিয়ে আসার মতো পুঁজি নেই। এবার ট্রাক ভাড়াও বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী ও সদর উপজেলার সীমান্তপথে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রতিরাতে অসংখ্য গরু ও মহিষ দেশের সীমানায় প্রবেশ করানো হচ্ছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দই খাওয়া, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়ন এবং নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সীমান্তের নদীপথে প্রচুর ভারতীয় গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এসব গরু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উপজেলার হাটগুলোতে বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে। সেখান থেকে ট্রাকযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট জেলার গরু ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় সূত্রগুলো আরও জানান, সীমান্তবর্তী যাত্রাপুরসহ কয়েকটি হাটে ভারতীয় গরু-মহিষ বিক্রির জন্য তোলা হচ্ছে। যাত্রাপুর হাটে ৫০-৬০ জন ভারতীয় গরুর কারবার করেন। প্রতি হাটে ৪০০-৫০০ ভারতীয় ছোট গরু ও ২০০-৩০০ বড় গরু ও মহিষ ওঠে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতীয় গরুর গায়ে এক ধরনের বিশেষ চিহ্ন দিয়ে রাখা হয়। এসব চিহ্ন থেকে সীমান্তের ওপারের গরুর মালিকের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। সাধারণত নামের আদ্যক্ষর দিয়ে এসব চিহ্ন দেয়া হয়। ব্রহ্মপুত্রের চর কালির আলগার একাধিক গরু ব্যবসায়ীর ভাষ্যমতে, ভাতীয় গরু ব্যবসায় রাত জেগে বর্ডারে থাকতে হয়। নদীপথে ইন্ডিয়ার ব্যবসায়ীরা গরু ভাসিয়ে দেয়। তারপর গরু ধরে আমাদের বুঝিয়ে দেয়। আমরা কমিশনের ব্যবসা করি। বিক্রি করে টাকা পাঠিয়ে দেই। ব্যবসায়ীরা আরও জানান, গরুর গায়ে চিহ্ন দেখে মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হন তারা। এক জোড়া গরু ধরে বুঝিয়ে দেয়ার পর কামলা বা রাখালদের পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দেয়া হয়। যাত্রাপুরের এক গরু ব্যবসায়ী বলেন, গরু ভেসে আসার সময় স্রোতের কারণে অনেক গরু মরে যায়। আবার আধমরা গরু চরের মানুষ ধরে জবাই করে ভাগাভাগি করে নেয়।
×