ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল সাহেদ

প্রকাশিত: ২১:৩২, ২৫ জুলাই ২০২০

অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল সাহেদ

আজাদ সুলায়মান ॥ দেশে করোনা তাণ্ডব ছড়ানোর আগে থেকেই পুলিশের কাছে মহাপ্রতারক হিসেবে চিহ্নিত ছিল রিজেন্ট চেয়ারম্যান সাহেদ। তার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার মামলা, জিডি ও অভিযোগ পেলেও কোন ব্যবস্থা নিতে পারত না পুলিশ। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সে ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে করোনা তাণ্ডবে গোটা দেশ ও সরকার যখন চরম অস্বস্তিতে, তখনই ভয়ঙ্কর রূপে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এই মহাপ্রতারক। তারপর থেকে কোন কুর্কীতিতে বাদ পড়েনি তার নাম। মূলত করোনা দুর্যোগকে কাজে লাগিয়েই প্রতিটি সেক্টরই গিলে খাওয়ার চেষ্টা করেছে এই মহাপ্রতারক। প্রভাবশালী মহলের দোহাই দিয়ে যেকোন অপকর্ম করে পার পেয়ে আসছিল। বিশেষ করে পুলিশকে ম্যানেজ করেই বেশি প্রতারণা চালানো হতো। তার বিরুদ্ধে জিডি মামলা, অভিযোগ দায়েরের পরও কোন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এমনকি থানায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও তাকে ধরা হয়নি। সাহেদের সহযোগীদের মতে- বছরখানেক আগে উত্তরায় একটি নামী-দামী হোটেল নিজের নামেই কাগজপত্র তৈরি করে ফেলে। আর এই ক্ষেত্রে বেশি সহায়তা করেছে পুলিশের দুই কর্মকর্তা ও তিন গণমাধ্যমকর্মী। এমনকি ওই হোটেলটি দেখিয়ে একটি ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছিল সাহেদ। আর ওই হোটেলেই রিজেন্ট ও কুয়েত-মৈত্রী সরকারী হাসপাতালের নার্সদের রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি উত্তরা রিজেন্সি হাসপাতালে চিকিৎসকদের রাখা হতো। ওই দুই হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের থাকা ও খাওয়ার বিল বাবদ ৫০ লাখ ১৮ হাজার ৪শ’ টাকা সে মেরে দিয়েছে। তাছাড়া তাদের নিয়মিত দেয়া হতো নিম্নমানের খাবার। এসব কাজে সাহেদকে সহযোগিতা করতেন কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের দুই উর্ধতন কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে দুই কর্মকর্তার নামে নালিশ গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। যেকোন সময় তাদের বরখাস্তের আদেশ আসতে পারে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রতারক মোঃ সাহেদের বিরুদ্ধে অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। চাকরি দেয়া, সরকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের বদলি, রিক্সা-ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স প্রদান ও জেল থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়ানোর নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে এসব টাকা নিয়েছেন তিনি। রিমান্ডে মোঃ সাহেদ ও তার দুই সহযোগী গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এ সম্পর্কে যে সব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তা খতিয়ে দেখতে এবং আরও তথ্য সংগ্রহে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। সাহেদকে দুই সহযোগীসহ গত বৃহস্পতিবার থেকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব। ১০ দিনের রিমান্ডে প্রথম ৫ দিন ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন একটি সংস্থার এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাহেদ নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করতে। পুলিশি প্রটোকল নেয়া, হেলিকপ্টারে যাতায়াত ও বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতা তিনি প্রতারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার প্রতারণার মাধ্যম ছিল বিভিন্ন সেক্টর। গত কয়েক বছরে চাকরি দেয়া, সরকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের বদলি, রিক্সা-ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স প্রদান ও জেল থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়ানোর নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য তিনি স্বীকার করেছেন। এ সব বিষয়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে সাহেদ ও তার দুই সহযোগীর দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সাহেদের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে খুব শীঘ্রই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে ওই সূত্র। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, সাহেদ একজন উঁচুমানের প্রতারক। তার কাছ থেকে নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সব সেক্টরেই সে প্রতারণা করেছেন। তাকে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের তালিকার কাজ চলছে। তথ্য প্রমাণ মিললেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পরীক্ষা না করেই করোনার সার্টিফিকেট প্রদান, টাকা নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও ভুয়া ফলাফল দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে র‌্যাবের কাছে রিমান্ডে থাকা রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৬০টি অভিযোগ পেয়েছে র‌্যাব। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, চাকরির আশ্বাসে অর্থ আত্মসাত, বদলি তদ্বির, রিক্সা-ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স প্রদান, পদ্মাসেতু প্রকল্পে পাথর-বালু ও বিটুমিন সাপ্লাইয়ের নামে প্রতারণা এবং সবশেষ জেল থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়ানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছেন সাহেদ। এ বিষয়ে র‌্যাব সূত্র জানিযেছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সরকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তারমধ্যে প্রতারক সাহেদের মালিকানাধীন উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতালকেও বাছাই করে। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের রাখার জন্য নামী-দামী কয়েকটি হাসপাতাল চূড়ান্ত করেন। কুয়েত-মৈত্রী ও রিজেন্ট হাসপাতালের জন্য উত্তরায় মিলিনা হোটেল। বছরখানেক আগে ওই হোটেলটি জোর করে দখলেও নেন প্রতারক সাহেদ। আর দখল করার পেছনে দুই জন বড় পুলিশ কর্মকর্তা ও তিন জন সাংবাদিককে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া আন্ডারগ্রাউন্ডের ৩ জন কথিত গণমাধ্যমকর্মীও এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। প্রতারক সাহেদ প্রশাসনকে জানায়, মিলিনা হোটেলটি তার নিজের। আর এই কথা শুনে প্রশাসনও আলাদাভাবে দেখেন সাহেদকে। নার্সদের থাকার জন্য ৩৬টি রুম চূড়ান্ত করা হয়। তাদের থাকা ও খাওয়া বাবদ প্রতিদিনই সরকারের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করতেন সাহেদ। গত তিন মাসে নার্সদের জন্য বরাদ্দ করা ৫০ লাখ ১৮ হাজার ৪শ’ টাকা মেরে দিয়েছে সাহেদ। আর এই কাজে সহযোগিতা করেছেন কুয়েত-মৈত্রী সরকারী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মোঃ সেহাব উদ্দিন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ আলিমুজ্জামান। উত্তরা থানা পুলিশ সূত্র জানিযেছে, করোনা তাণ্ডব ছড়ানোর আরও অনেক আগে থেকেই সাহেদ মহাপ্রতারক হিসেবে চিহ্নিত। সব সেক্টরেই তার প্রতারণা রয়েছে। এছাড়াও সাহেদ ঠগবাজি ও মিথ্যাচারেও ওস্তাদ। হোটেল থেকে শুরু করে মানুষের সহায়-সম্পত্তি দখল করেছেন। শেষ পর্যন্ত নার্সদের বিলের টাকাও মেরে দিয়েছেন সাহেদ। তাদের নিম্নমানের খাবার সরবারহ করতেন। এমনকি হোটেলে গিয়ে নার্সদের অনৈতিক প্রস্তাবও দিতেন সাহেদ। দেশে মহামারী করোনাকালে যিনি চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রতারণা করতে পারেন- সে নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছু করেছেন। তার এমন প্রতারণার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ ও র‌্যাবের দুই কর্মকর্তা বলেন, নার্সদের খাবার বিলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কেনার নামে সাহেদ এতবড় দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। নার্সদের যে খাবার দেয়ার কথা ছিল তার কাছেও ছিল না খাবারের মান। এই নিয়ে নার্সরা একের পর অভিযোগ করেছিল। সাহেদ হোটেল নিজের নাম ব্যবহার করে প্রতিটি রুম প্রতিদিন ৮৫০০ টাকা করে হাতিয়ে নিতেন। এমনকি চিকিৎসকদের রিজেন্সি হোটেলের টাকাও সে মেরে দিয়েছে। এমনকি বছরখানেক আগে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে মূল মালিককে তাড়িয়ে দিয়ে মিলিনা হোটেলটি দখলে নিয়েছেন। এই হোটেলের নাম করে একটি ব্যাংক থেকে ১০ কোটি টাকার ঋণ নেয়া চূড়ান্ত করেছিলেন। কিন্তু তার জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। হোটেল মালিক আনোয়ার হোসেনকে পুুলিশের দুই কর্মকর্তা ও তিন সাংবাদিক ভয়ভীতি দেখিয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছি।
×