ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অজ্ঞান বা মলমপার্টির বিরুদ্ধে পুলিশ তৎপর

বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে হকারদের ছবিসহ তালিকা হচ্ছে

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ১৫ জুলাই ২০২০

বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে হকারদের ছবিসহ তালিকা হচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে ঈদে মানুষকে বাড়ি না যেতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তারপরেও যারা যাচ্ছেন তারা যেন অজ্ঞানপার্টি বা মলমপার্টির খপ্পরে না পড়েন এজন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। দেশের প্রতিটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও লঞ্চ টার্মিনালের হকারদের ছবিসহ তালিকা তৈরির কাজ করা হচ্ছে। নতুন কোন হকারদের বাস বা লঞ্চ টার্মিনালে বসতে দেয়া হচ্ছে না। কারণ বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে থাকা হকার আর তাদের সহযোগীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট খাবারের সঙ্গে নেশার ওষুধ মিশিয়ে যাত্রীকে খাইয়ে দিয়ে যাত্রীর সঙ্গে থাকা মালামাল হাতিয়ে নেয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার প্রকৌশলী মোঃ ওয়ালিদ হোসেন জানান, ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীতে মৌসুমি অপরাধীদের তৎপরতা বাড়ে। এসব অপরাধীদের অধিকাংশই ছিনতাই, ডাকাতি, গ্রিল কেটে বাসা বাড়িতে চুরি করে থাকে। এই মৌসুমি অপরাধীরা ঈদের সময় বেশি তৎপর থাকে। এদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম। বিশেষ করে বাস টার্মিনালগুলোতে এবং লঞ্চ টার্মিনালে থাকা হকারদের ছবিসহ তালিকা করা হচ্ছে। নতুন করে বাস টার্মিনাল ও লঞ্চ টার্মিনালে কোন হকার বসতে দেয়া হচ্ছে না। কারণ এসব হকারের বিরুদ্ধে খাবারের সঙ্গে ঘুম বা নেশার ওষুধ মিশিয়ে টার্গেটকৃত যাত্রীদের খাইয়ে, যাত্রীর সঙ্গে থাকা সব মালামাল হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে। এছাড়া টার্মিনালগুলো থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসের ও যাত্রীদের ভিডিও করে রাখা হবে। বর্তমানে গভীর রাতে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীবাহী বাসের ভিডিও করে রাখা হচ্ছে। অনেক সময় প্রয়োজন মনে হলে দিনের বা বিকেলে ছেড়ে যাওয়া বাস ও যাত্রীদের ভিডিও করে রাখা হয়। হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মল্লিক ফখরুল ইসলাম জানান, দেশের প্রতিটি বাস টার্মিনালে যাত্রী ও বাসের ভিডিও করে রাখা হবে। এর মধ্যে ঢাকাসহ দেশের সব মেট্রোপলিটন এলাকার বাস টার্মিনালগুলোর যাত্রীবাহী পরিবহন ও পরিবহনের যাত্রীদের ভিডিও করবে সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং জেলা পুলিশ। থানা পর্যায়ে থাকা বাস টার্মিনালের তেমন কোন ভিডিও করার প্রয়োজন হয় না। কারণ এসব টার্মিনালের হকাররা স্থানীয়। তাদের প্রায় সবাই চেনা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। আর জেলাগুলোর বাস টামির্নালের যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে হতাহতদের সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এছাড়া দূরপাল্লার যানবাহনের চালকদের ড্রাগ মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। যন্ত্রটি শরীরে লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তি মাদকাসক্ত বা মাদক সেবন করেছে কি না তা সিগ্যনাল দেবে। কারণ অনেক চালক মাদকাসক্ত হয়ে বা মাদক সেবন করে যানবাহন চালায়। যেসব চালক মাদক সেবন করেছে বলে প্রমাণ হবে তাদের যানবহন চালাতে দেয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। মহাসড়কের চেকপোস্টগুলোতেও এমন ব্যবস্থা থাকবে। কারণ অনেক চালক টার্মিনালে মাদক সেবন না করে রাস্তায় গিয়ে সেবন করে। এসব চালকদের প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের সাজা দেয়া হবে। এতে করে মহাসড়কে দুর্ঘটনা কম ঘটবে। যাত্রীদের অজ্ঞানপার্টি বা মলমপার্টির কবল থেকে রক্ষা করতে যাত্রীবাহী পরিবহনে হকার উঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেসব পরিবহন এই নির্দেশনা না মানবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে মহাসড়কের আশপাশে কোন প্রকার কোরবানির পশুর হাট বসতে দেয়া হচ্ছে না। কারণ মহাসড়কের আশপাশে কোরবানির পশুর হাট বসলে তার প্রভাব পড়ে মহাসড়কে। এছাড়া মহাসড়কে সব ধরনের নছিমন করিমন চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেসব লিংক রোড দিয়ে নছিমন করিমন মহাসড়কে ওঠে, সেসব স্থানে পুলিশ মোতায়েন করার পাশাপাশি বাড়তি নজর রাখা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, সারাদেশের ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার মহাসড়কের ওপরই তারা নজর রাখছেন তারা। বিআরটিএ-র পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনকৃত প্রায় ২১ লাখ বিভিন্ন প্রকারের যানবাহন চলাচল করে। যদিও বাস্তবে চলে ২৫ লাখেরও বেশি। এরমধ্যে গড়ে সারাবছরই এক লাখ পরিবহন গ্যারেজে থাকে। যা মহাসড়কের পরিমাণের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। দেশে বৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এছাড়া প্রায় ১১ লাখ অবৈধ চালক রয়েছে। অবৈধ চালকরা ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে লাইসেন্স নিয়ে থাকে। ভুয়া নাম ঠিকানায় লাইসেন্স ব্যবহার করার কারণে মহাসড়কে ছিনতাই বা দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামি হিসেবে চালকদের আর গ্রেফতার করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। পরিমাণের তুলনায় অতিরিক্ত যানবাহন চলাচল, দ্রুতগতি ও দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার কারণে মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, মহাসড়কে ২০৮টি ব্ল্যাকস্পট বা দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গার মধ্যে বর্তমানে শতাধিক ব্ল্যাকস্পট আছে। বাকিগুলো ইতোমধ্যেই মেরামত করা হয়েছে। ব্ল্যাকস্পটের কারণে যানজট, দুর্ঘটনা ও নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। প্রতিবছর গড়ে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় প্রায় ৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আর গড়ে অন্তত ২০ হাজার মানুষ আহত হন। আহতদের মধ্যে গড়ে অন্তত ৫ হাজার জনকে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়। এদের মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মেরামতের বাইরে থাকা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ব্ল্যাকস্পটে উজ্জ¦ল আলোর বিকিরণক্ষম বড় বড় সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা, সাবধানে চলাচল করুন।’ গতিসীমাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এসব স্পষ্টগুলোতে পুলিশ এবং সড়ক ও জনপথের রেকার রাখা হয়েছে। যাতে কোন যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়লে না বিকল হলে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যানজট নিরসন করা যায়। দুর্ঘটনাপ্রবণ ও অপরাধপ্রবণ অনেক এলাকায় সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন, চালক, দুর্ঘটনার কারণ ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যাতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে যে কোন ঘটনার তদন্ত এবং দোষীদের গ্রেফতার করতে সহজ হয়। হাইওয়ে পুলিশ প্রধান বলছেন, মহাসড়কের দুই পার্শ্বে নিয়মানুয়ায়ী সারাবছর ধরেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ চালানোর কথা। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরেও উচ্ছেদ অভিযান শতভাগ সফল হয়নি। এতে করে দুর্ঘটনা ঘটে। উচ্ছেদ অভিযান চালাতে সংশ্লিষ্ট জেলার প্রশাসক, জেলা পুলিশ, সড়ক ও জনপথ, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। উচ্চ আদালত মহাসড়কের উভয় পার্শ্বে ১০ মিটার পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার নির্দেশনা দিয়েছে। সেই নির্দেশনা কার্যকর করতে তারা স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তৎপরতা শুরু করেছেন।
×