ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের ওপর সন্তু বাহিনীর হামলা

বান্দরবানে ফের ব্রাশফায়ারে ছয় খুন

প্রকাশিত: ২২:২২, ৮ জুলাই ২০২০

বান্দরবানে ফের ব্রাশফায়ারে ছয় খুন

মোয়াজ্জেমুল হক/ জীতেন বড়ুয়া/ বাসু দাশ ॥ বেশ কিছু সময় চাপা থাকার পর পার্বত্য জেলা বান্দরবানে অজ্ঞাত পরিচয় পাহাড়ী দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে ফের প্রাণ হারিয়েছে ৬ জন। এছাড়া আহত হয়েছে আরও ৩ জন। নিহতদের পরিচয় মিলেছে। এরা সকলেই জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) এমএন লারমা গ্রুপের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের এ অপারেশনটি চালানো হয়েছে মঙ্গলবার সকাল ৭টার দিকে। সদর উপজেলার বাগমারা বাজারপাড়ার জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের জেলা সমন্বয়ক রতন তঞ্চঙ্গার বাসায়। এ ঘটনায় রতন তঞ্চঙ্গাও (৫৫) প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত অপর ৫ জন হলেন, প্রজিত চাকমা (৬৫), ডেভিড মার্মা (৪৫), জয় ত্রিপুরা (৪০), দীপেন ত্রিপুরা (৪২) ও বিমল কান্তি চাকমা ওরফে বিধু বাবু (৬০)। আহত তিনজন হলেন নিহার চাকমা, বিদ্যুত চাকমা ও হ্লাওয়াংসিং। আহতদের প্রথম দুজনকে গুরুতর অবস্থায় বান্দরবান সদর হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। সংঘটিত এ ঘটনার পর এলাকা ও এর আশপাশের জনসাধারণের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। ইতিপূর্বেও জনসংহতি সমিতির দু’গ্রুপের মধ্যে হানাহানির ঘটনা ঘটলেও একসঙ্গে ব্রাশফায়ারে ৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা হচ্ছে, ওই বাসার অভ্যন্তর ও আঙ্গিনায় যারাই ছিলেন সকলকে উদ্দেশ্য করে ব্রাশফায়ার চালানো হয়েছে। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাস্থলটি বান্দরবান সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এবং বান্দরবান সেনা জোনের নিয়ন্ত্রণে। সংস্কারপন্থী শীর্ষ নেতা রতন তঞ্চঙ্গার বাগমারার এ বাসায় অন্যরা এসেছিল খাগড়াছড়ি থেকে। তারা সকলেই এ বাসায় রাত যাপন করেন। মঙ্গলবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতরাশ সারার জন্য কেউ বাড়ির আঙ্গিনায় আর কেউ বাসার ভেতরে ছিলেন। এ অবস্থায় সকাল ৭টার দিকে অর্ধ শতাধিক সশস্ত্র পাহাড়ী দুর্বৃত্ত বাড়িটি ঘেরাও করে। এদের মধ্যে তিনজন ব্রাশফায়ার চালায়। ঘটনাস্থলেই উক্ত ৬ জনের মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয় আরও ৩ জন। তবে ভাগ্যক্রমে রতনের স্ত্রী ও সন্তানরা প্রাণে বেঁচে যায়। আশপাশের এলাকার লোকজন জানিয়েছেন দশ থেকে পনেরো মিনিটের অপারেশন শেষে দুর্বৃত্তরা পার্শ^বর্তী ঘন জঙ্গলে পালিয়ে যায়। ব্রাশফায়ারের শব্দে ঘটনাস্থল ও আশপাশ এলাকা রীতিমতো প্রকম্পিত হয়। রাজভিলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান খে অং প্রু মার্মা, বান্দরবান সদর থানার ওসি শহীদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘটনার বেশ কিছু সময় পর খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার করে এবং আশপাশ এলাকায় তল্লাশি চালায়। কিন্তু সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সন্দেহজনক কেউ গ্রেফতার হয়নি। ৬নং নোয়াপতং ইউনিয়ন মেম্বার মিছি মার্মা জানিয়েছেন, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় নিহত ৬ জনের বীভৎস লাশ দেখেছেন। এদের কারও কারও নাড়িভুঁড়িও বের হয়ে গেছে। বান্দরবান সদর হাসপাতালের চিকিৎসক সমীরণ নন্দী জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে দু’জনের অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাদের চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। দুপুরের পর যৌথ বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল ও আশপাশ এলাকা অভিযান শুরু করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে জানানো হয়েছে, এ ঘটনা জেএসএসের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের। তবে অন্য সূত্রগুলো বলেছে, জেএসএস সন্তু লারমা গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসার জের হিসেবে এ হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে। এ ধরনের হত্যাকান্ড পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে দফায় দফায় সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া জেএসএস সন্তু গ্রুপের সঙ্গে ইউপিডিএফেরও সংঘাত বিদ্যমান রয়েছে। অন্য কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, জেএসএস সন্তু গ্রুপ থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা ছিল রতন তঞ্চঙ্গার নেতৃত্বাধীন গ্রুপের। জেএসএস সন্তু গ্রুপ থেকে যারাই বেরিয়ে আসছেন তাদের সংস্কারপন্থী হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং এরা স্বাভাবিক জীবনে চলে আসার প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে ধরা হয়। পাহাড়ের এ এলাকা আবারও অশান্ত হওয়ায় বিবদমান গ্রুপগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সন্তু লারমা অনুসারীদের ব্রাশফায়ারে সংস্কারপন্থী গ্রুপের এ ৬ শীর্ষ নেতা প্রাণ হারিয়েছে বলে অনেকটা নিশ্চিত। বান্দরবান পৌর মেয়র জেএসএসের দুগ্রুপের মধ্যে এবং সহিংস কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়ে দোষীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কথা বলেছেন। এদিকে, নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত, জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের শীর্ষ এ নেতৃবৃন্দের অধিকাংশ সময় এ বাড়িতেই থাকতেন। বিষয়টি সন্তু গ্রুপের জানা হওয়ার পর বাড়িটিকে টার্গেট করা হয় এবং মঙ্গলবারের অপারেশনের আগে গোপনে রেকিও করা হয়। এদিকে বান্দরবান পুলিশ জানিয়েছে, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দীর্ঘ সময় জুড়ে জেএসএসের দুগ্রুপের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এরই জের হিসেবে নৃসংশ এই হত্যাকান্ড। বান্দরবান সদর থানার ওসি শহীদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ঘটনার পর গুলিবিদ্ধ ৩ জনকে উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার জেরিন আক্তার ঘটনা খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। পুলিশ নিহতদের বিষয়ে জানিয়েছেন, এদের রতন তঞ্চঙ্গার বাড়িই শুধু বাগমারা এলাকায়। অপর ৫ জন সকলেই খাগড়াছড়ির বাসিন্দা। খাগড়াছড়িতে প্রতিবাদ সমাবেশ ॥ এদিকে, বান্দরবানের ৬ খুনের ঘটনার প্রতিবাদে জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপের পক্ষে মঙ্গলবার বিকেলে খাগড়াছড়িতে প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করা হয়েছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের মহাজনপাড়ায় সূর্যশিখা ক্লাবের সামনে থেকে শুরু করে প্রতিবাদ মিছিলটি প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাপলা চত্বর এসে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএস) জেলা শাখার সহ-সভাপতি সুভাষ চাকমার সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, সহযোগী সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি দীপন চাকমা, জেএসএস এম এন লারমা গ্রুপের জেলা কমিটির যুব বিষয়ক সম্পাদক প্রত্যয় চাকমা প্রমুখ। এই বিক্ষোভ মিছিলে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও জেএসএস সংস্কারের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। এ সময় সমাবেশে বক্তারা হত্যাকান্ডের জন্য সন্তু লারমাকে দায়ী করে নেতাকর্মীরা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আটকসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। সেই সঙ্গে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস পাহাড়ে চুক্তির পর থেকে হত্যার রাজনীতিতে মেতে উঠেছে অভিযোগ তুলে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ করা না হলে তার ফল সুখকর হবে না বলেও জানিয়ে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেন। বক্তারা ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে কঠোর কর্মসূচী দেয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
×