ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবার মধ্যাঞ্চলে বাড়ছে বন্যার পানি

প্রকাশিত: ২২:২৫, ১ জুলাই ২০২০

এবার মধ্যাঞ্চলে বাড়ছে বন্যার পানি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবার দেশের মধ্যাঞ্চলে বাড়ছে বন্যার পানি। ইতোমধ্যে পদ্মার পানি বেড়ে দৌলতদিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ধলেশ্বরী নদীর পানিও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে মধ্যাঞ্চলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদ্মার পানি বেড়ে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে পারে। অপরদিকে উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। তারা জানায়, উত্তরের প্রধান নদী যমুনা এখনও ৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও পানি স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছেন পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ দেশের ৯ নদীর পানি ১৫ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদী অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। এদিকে পদ্মা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার প্রচন্ড স্রোতে তোড়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং শিমুলিয়া কাঁঠালবাড়ি রুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে দেশে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা ও মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। মঙ্গলবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ নির্দেশনা দেয়া হয় বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পদ্মা পানি বেড়ে যাওয়া এবং উত্তরের পানি নেমে আসার কারণে মধ্যাঞ্চলে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুরসহ কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। ইতোমধ্যে গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা জানায়, ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি আরিচায় এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভাগ্যকূল পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে এই এলাকায় পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়তে পারে। সংস্থাটির পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, যমুনা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতলে স্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। পদ্মা নদীর পানি সমতলে বাড়ছে। এটা অব্যাহত থাকতে পারে। অপরদিকে মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানি কমছে। ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে পারে বলে জানিয়েছে তারা। সিলেট সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এদিকে তারা জানায়, ধরলা, ঘাগট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, ধলেশ্বরী, পদ্মা, সুরমা পুরাতন সুরমা নদীর পানি ১৫টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার ভিডিও কনফারেন্সে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব, খাদ্য সচিব, রংপুর, রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনারসহ ১২ জেলার জেলা প্রশাসকেরা সভায় যুক্ত ছিলেন। সভায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কবির বিন আনোয়ার বন্যা পরিস্থিতির সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব বরাদ্দ ত্রাণসহ বন্যা মোকাবেলায় নেয়া পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে বন্যা মোকাবেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জেলা প্রশাসকরা নিজ নিজ জেলার বন্যা পরিস্থিতি ও গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাঠ প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি রয়েছে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংরক্ষণ ও মেরামত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি খাতের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য ইউনিয়ন ওয়ার্ড কমিটিগুলো সার্বক্ষণিক কাজ করছে। বন্যাকবলিত ৯ জেলায় এ পর্যন্ত ৬৬০ মেট্রিক টন চাল ও ৬৭ লাখ টাকা নগদ দেয়া হয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশে ভারি বর্ষণের প্রবণতা ইতোমধ্যে কমে এসেছে। সারাদেশেই এখন স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই সপ্তাহের শেষ নাগাদ এই অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে। এরপর আবারও বৃষ্টির প্রবণতা বাড়তে পারে। তারা জানায় বর্তমানে মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে অসম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আর মৌসুমি বায়ু বাংলাদের উপর সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে সারাদেশেই কম-বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আবহাওয়াবিদ মোঃ আব্দুর রহমান বলেন, বর্তমানে মৌসুমের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কয়েকদিন আগের চেয়ে এখন কিছুটা কমেছে। কয়েকদিন পর আবার এটা বাড়তে পারে। গাইবান্ধা ॥ ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা বন্যা কবলিত হচ্ছে এবং বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির আরও মারাত্মক অবনতি হচ্ছে। সেইসঙ্গে গোবিন্দগঞ্জের করতোয়া এবং ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে নদী ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বন্যার পানির তোড়ে শহর রক্ষা বাঁধে বালু সরে গিয়ে বাঁধের ৪ পয়েন্টে ফুটো দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে। সেইসঙ্গে বাঁধের গোড়ার মাটি ধসে যাচ্ছে। ফলে শহর রক্ষা বাঁধটি এখন চরম হুমকির মুখে। এদিকে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নের ২৫ গ্রামে বসতবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় প্রায় ৫শ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নীলফামারী ॥ তিস্তা নদীতে পানি কমলেও ভাঙ্গন বেড়েছে। এতে নতুন করে ডিমলা উপজেলাার ছাতুনামা, বাইশপুকুর, চরখড়িবাড়ি ও কিছামত ছাতনাই এলাকায় আরও ৩৯ বসতঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। গত দুইদিন ধরে তিস্তা অববাহিকায় বৃষ্টিপাত ছিল না। নেত্রকোনা ॥ বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। উব্দাখালি, সোমেশ্বরী ও কংস নদী দিয়ে ঢলের পানি ক্রমশ ভাঁটির দিকে যাচ্ছে। তবে কলমাকান্দা সদর, রংছাতি, খারনৈ ও বড়খাপন ইউনিয়নে প্লাবিত শতাধিক গ্রামের মধ্যে অন্তত ৭০ গ্রাম এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। জামালপুর ॥ জামালপুরে ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইলেও পানি বৃদ্ধির মাত্রা কিছুটা কমে এসেছে। ফলে জেলার ছয়টি উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ ইউএনও অফিস চত্তরে পানি উঠায় স্থবির হয়ে পড়েছে সেখানকার কার্যক্রম। বন্যার পানিতে ডুবে জেলার মাদারগঞ্জে ছয় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কুড়িগ্রাম ॥ কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এদিকে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর নারায়ণপুর ইউনিয়নে ৭ বছরের এক শিশু বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় মানুষজন উঁচু বাঁধ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিচ্ছেন বানভাসিরা। জেলার দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষ এবারের বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে। শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ গো-খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দিনে-রাতে বৃষ্টির কারণে জ্বালানি খড়-খড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বানভাসিদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে। সরকারী হিসেব অনুযায়ী বন্যায় জেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ৩৫৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ১৫ হাজার ৬শ পরিবারের ৬৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তবে বেসরকারীভাবে আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে ৪০৫টি চর-দ্বীপ চরে। নদী ভাঙ্গনে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ঘরবাড়ি হারিয়েছে ৫শ পরিবার। ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ ৩৭ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। এছাড়াও কৃষিতে পাট, আউশ ধান, আমন বীজতলা, তিল এবং সবজিসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ হাজার ৬৫৩ হেক্টর ফসলী জমি। পানিবন্দী মানুষদের খাদ্য সঙ্কট শুরু হয়েছে। তারা এ মুহূর্তে শুকনো খাবার চায়। কারণ রান্না করার মতো কোন জায়গা নেই তাদের। গ্রামীণ সব টিউবয়েলগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় তীব্র পানির সঙ্কটও শুরু হয়েছে।
×