ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

করোনার প্রাদুর্ভাব এবং বিশ্বায়ন বাস্তবতা

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৪ জুন ২০২০

করোনার প্রাদুর্ভাব এবং বিশ্বায়ন বাস্তবতা

নভেল করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এবং প্রাণসংহারী বিস্তার ঘটানোর পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংক্রামক ব্যাধি মোকাবেলার সক্ষমতা কেমন, তা আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে। নভেল করোনা চিরন্তন সত্যটা আমাদের সবাইকে আবার জানিয়ে দিয়েছে যে অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও মৌলিক সেবার সহজলভ্যতা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির চেয়েও রোগ-ব্যাধি মোকাবেলার সক্ষমতা জাতি-রাষ্ট্র-সমাজের কাছে প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। একটা দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সামরিক শক্তির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী এবং দুর্যোগকালীন রাষ্ট্র সাধারণ মানুষকে কতটা সুরক্ষা দিতে সক্ষম, সেটাই জনমানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। নভেল করোনা সেটাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ২০১৫ সালে টেডএক্সের এক বক্তৃতায় সংক্রামক ভাইরাসের যে আশঙ্কার কথা বলেছিলেন, ২০২০ সালে এসেই তা এক নির্মম বাস্তবতা হয়ে আমাদের সামনে দেখা দিয়েছে। বিল গেটস সেদিন বলছিলেন, ‘আগামী কয়েক দশকে কোন কারণে যদি লাখ লাখ মানুষ মারা পড়ে, তাহলে কারণটি মোটেও যুদ্ধ হবে না; মানুষ মারা পড়বে ভীষণ সংক্রামক কোন ভাইরাসের সংক্রমণে। মানুষ মিসাইলের আঘাতে প্রাণ হারাবে না, প্রাণ যাবে ক্ষুদ্র জীবাণুতে। এর কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো, আমরা পারমাণবিক প্রতিরোধক তৈরিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছি অথচ একটি মহামারী ঠেকানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগের বেলায় সত্যিকার অর্থে আমাদের বিনিয়োগ সামান্যই। আমরা পরবর্তী মহামারীর জন্য প্রস্তুত নই। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিই আমাদের বলে দেয় বিশ্ব অর্থনীতির ব্যর্থতাটা কোথায়। বিশ্বায়ন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতিতে পরিণত করলেও গত বছরের তুলনায় স্বাস্থ্য সেক্টরে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা চরমে পৌঁছেছে। করোনাভাইরাস বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, তা ১৯৩০ সালের পর বিশ্বে আরেকটি মহামন্দার জন্ম দিতে যাচ্ছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য এখন থমকে গেছে। মেক্সিকো যে গাড়ি রপ্তানি করত, তা শতকরা ৯০ ভাগ কমে গেছে। হিথরো বিমানবন্দরের যাত্রী মুভমেন্ট শতকরা ৯৭ ভাগ কমে গেছে। যাত্রীবাহী অনেক বিমান সংস্থা এখন তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে অথবা জনবল ছাঁটাই করবে। প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হ্রাস পেয়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। অথচ বিশ্বায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অবাধ যাত্রী মুভমেন্ট, সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া, আর অবাধ বাণিজ্য। এখন তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সিএনবিসি গত ২৪ এপ্রিল তাদের এক প্রতিবেদনে সাতটি ক্ষেত্র উল্লেখ করেছে, যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী বেকার সমস্যা বেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে এই হার শতকরা ৪.৪ ভাগ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩.৮ ভাগ, জার্মানিতে ৫ ভাগ, অস্ট্রেলিয়ায় ৫.২ ভাগ আর চীনে ৫.৯ ভাগ। খুচরা বিক্রি অর্থনীতির অন্যতম শক্তি। কিন্তু দেখা যায়, চীনে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর পরিমাণ যেখানে ছিল ১০ ভাগ, সেখানে ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ এর পরিমাণ কমেছে মাইনাস ১৫.৮ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রে ওই সময় এর পরিমাণ ০.০ ভাগ থেকে কমেছে মাইনাস ৬.২ ভাগ। পিএমআই অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অন্যতম ইন্ডিকেটর বা নির্দেশক। পিএমআই যদি ৫০-এর নিচে থাকে, তা অর্থনীতিতে সংকোচনের আভাস দেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী চীনে সার্ভিস সেক্টরে পিএমআই-এর পরিমাণ ৪৩, যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯.৮, জাপানের ৩৩.৮ আর ইউরো জোনের ২৬.৪। অন্যদিকে উৎপাদন খাতে পিএমআই চীনে ৫০.১, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৯.২, জাপানে ৪৪.৮ আর ইউরো জোনে ৪৪.৫। অর্থাৎ শুধু চীনে উৎপাদন খাত সম্প্রসারিত হয়েছে, অন্যান্য অঞ্চলে সঙ্কুচিত হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বিশ্ববাণিজ্যের যে প্রাক্কলন করেছে, তাতে দেখা যায় বিশ্ববাণিজ্যে ১২.৯ থেকে ৩১.৯ ভাগ পর্যন্ত ঘাটতি হবে। এই বাণিজ্যে প্রতিটি অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা বিশ্বায়ন বা মুক্তবাণিজ্যের পরিপন্থী। আইএমএফের মতে, বিশ্ব জিডিপি ২০২০ সালে হ্রাস পাবে মাইনাস ২.৫ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৬ ভাগে হ্রাস পাবে। জাপান ও জার্মানিতেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৫ ও মাইনাস ৭ ভাগে হ্রাস পাবে। শুধু চীনে প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে প্লাস ৫ ভাগের ওপরে। আইএমএফের মতে, ২০২০ সালে বিশ্ব প্রায় ৯ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, চলতি ২০২০ সালে ১৭০টি দেশে মাথাপিছু আয় কমবে। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচক অনুযায়ী ১২টি দেশ মহামারী মোকাবেলায় ‘অধিক প্রস্তুত’, সূচকে যাদের মান ৮৩ দশমিক ৫ থেকে ৬৭-এর মধ্যে এবং এগুলো প্রধানত উচ্চ আয়শ্রেণীর দেশ; ক্রমানুযায়ী-আমেরিকা, যুক্তরাজ্য। এমনকি নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, থাইল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, সেøাভেনিয়া ও সুইজারল্যান্ড। থাইল্যান্ড একমাত্র ব্যতিক্রম, যারা মধ্য আয়শ্রেণীর দেশ ও থাইল্যান্ড ছাড়া এশিয়ার অন্য দেশ হলো দক্ষিণ কোরিয়া। এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা অন্যান্য দেশের জন্য অনুপ্রেরণার উদাহরণ হতে পারে, যারা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে সারা বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে আছে এবং একমাত্র মধ্যম আয়ের দেশ ও এশিয়ার মধ্যে প্রথম। থাইল্যান্ড প্রমাণ করে দেখিয়েছে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে অর্থের চেয়েও রাষ্ট্রের সদিচ্ছাই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে তোলাটা সংক্রামক ব্যাধি মোকাবেলায় কতটা কার্যকর হতে পারে। এছাড়া অধিক প্রস্তুত দেশগুলোর মধ্যে অধিকাংশই উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের দেশ। মহামারী মোকাবেলায় ‘মোটামুটি প্রস্তুত’ শ্রেণীতে আছে ১০৯টি দেশ, যাদের সূচক মান ৬৬ থেকে ৩৩ দশমিক ৭-এর মধ্যে। ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, আলবেনিয়া, মধ্য আয়শ্রেণীর দেশ হওয়া সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে এ সূচকে ভাল করেছে এবং প্রথম ৪০টি দেশের মধ্যে তাদের অবস্থান। বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের অবস্থান ৫১তম এবং স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্বে আমেরিকার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ৬৩তম অবস্থানে অথচ অর্থনীতির মানদ-ে এগিয়ে থাকা শৌর্য-বীর্যে অমিত শক্তিধর এই রাষ্ট্রগুলোর কী নেই! বিশ্বের যে কোন প্রান্তের মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে দেয়ার মতো শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র এমনকি আছে জীবাণু বোমাও। অথচ বর্তমান ভয়াল বাস্তবতায় জীবাণু আর ব্যাধি থেকে নিজ দেশের সাধারণ জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার মতো অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার স্বল্পতার বিষয়টি এখন করুণ বাস্তবতা। সার্বিক বিচারে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সূচকে এগিয়ে থাকা, বিশ্বে তুলনামূলকভাবে প্রস্তুত উন্নত দেশগুলোই করোনা মোকাবেলায় জনগণকে পুরোপুরি স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে পারছে না। এ বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় দুর্বল উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর জন্য করোনার প্রকোপ হতে যাচ্ছে ভয়াবহ। বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের জন্য করোনা এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নিয়ে আসতে পারে, যার আলামত এখন সুস্পষ্ট। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী যেসব পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ডিগ্লোবালাইজেশন’ বা বিশ্বায়নের বিনির্মাণ। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী যে আবেদন সৃষ্টি করেছিল, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ব্যর্থতা বিশ্বায়নের সেই আবেদনকে ভেঙে দিয়েছে। বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের গত ১৬ মের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছিল বিদায় বিশ্বায়ন। ইকোনমিস্টের মতে, বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এবং বিশ্বায়ন বিশ্ব অর্থনীতিকে দুই দশক ধরে নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামিয়েছে এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা করতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটিয়েছে এবং নতুন করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করতে যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রকাশ্যেই চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন। বিদ্যমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সামনের দিনগুলোয় সংক্রামক ব্যাধি মোকাবেলায় ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে বিশ্বের দেশগুলোকে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ পরিকল্পনা এবং জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাকে সমন্বিতভাবে একই কর্মকৌশলের অধীনে সাজাতে হবে, যাকে বলা হচ্ছে একীভূত স্বাস্থ্য কৌশল। আর এ কৌশলের অধীনে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা একে অন্যের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করবেন এবং ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, নগর পরিকল্পনা, জলবায়ু দুর্যোগ পরিকল্পনা ইত্যাদির সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই সংক্রামক ব্যাধি মোকাবেলা করা এবং প্রাণীসৃষ্ট, মানবসৃষ্ট অথবা পরিবেশগত বিপর্যয়গুলোর বৃহৎ প্রভাব সামনের দিনগুলোয় এড়ানো সম্ভব হবে। আমরা জাতি-রাষ্ট্রগুলো প্রবৃদ্ধির উন্মাদনায় মশগুল ছিলাম এতকাল। উন্নয়নের রোশনাই আর ক্ষমতার আভিজাত্যের গৌরব এখন মিথ্যে প্রহেলিকা হয়ে দেখা দিয়েছে এক নতুন অণুজীবের আগমনে। নভেল করোনা আমাদের বাধ্য করেছে রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্যগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে। আমরা এখন নিরুপায় হয়ে জানার চেষ্টা করছি রাষ্ট্রের মৌলিক স্বাস্থ্য অবকাঠামোর বিদ্যমান অবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তার কথা। জরুরী অবস্থায় আমাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্রের সক্ষমতা এখন আলোচনার কেন্দ্রে। এখানেই নভেল করোনাভাইরাসের অভিনবত্ব, তার নভেল নামের সার্থকতা। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×