ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত রিপোর্ট

ইউনাইটেডে অগ্নিকান্ড অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায়

প্রকাশিত: ২২:১৩, ৭ জুন ২০২০

ইউনাইটেডে অগ্নিকান্ড অবহেলা আর অব্যবস্থাপনায়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে খ্যাতিমান ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরজন্য পুরোপুরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গঠিত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির গভীর তদন্তে ওঠে এসেছে এমন তথ্য। তদন্ত করার সময় হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট আঠারো জন কর্মকর্তা কর্মচারী এবং নিহত দুই রোগীর স্বজনদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। তদন্তের পাশাপাশি তাদের বক্তব্যেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আজ রবিবার তদন্ত রিপোর্টটি ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইনের কাছে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। গত ২৭ মে দিবাগত রাত সাড়ে নয়টার দিকে হাসপাতালটির বাউন্ডারির ভেতরে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় স্থাপিত মাত্র পাঁচ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে পাঁচটি বেডে থাকা পাঁচজনই জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। নিহতরা হচ্ছেন, রিয়াজুল আলম (৪৫), খোদেজা বেগম (৭০), ভেরন এ্যান্থনী পল (৭৪), মনির হোসেন (৭৫) ও মাহাবুব এলাহী চৌধুরী (৫০)। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের তরফ থেকে গঠিত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক দেবাশীর্ষ বর্ধন জনকণ্ঠকে বলেন, তদন্ত প্রায় শেষ। রবিবার বা সোমবার নাগাদ প্রতিবেদনটি ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হবে। তদন্ত কমিটি সরেজমিনে একাধিকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নানা বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সংগৃহীত অনেক আলামতের ফরেনসিক টেস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে। তদন্তে হাসপাতালটির অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার কারণে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তদন্তের ধারাবাহিকতায় হাসপাতালটির কর্মকর্তা কর্মচারীসহ দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট ১৮ জনের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে। তাতেও ফুটে ওঠেছে এমন চিত্র। এর বাইরে নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও এমন অভিযোগ করেছেন। নিহতদের মধ্যে ভেরন এ্যান্থনী পল ও আরও একজনের পরিবারের এক সদস্যের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। কাকতালীয় হলেও সত্য, তদন্তে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে জবানবন্দী দাতা এবং ভেরন এ্যান্থনী পলের পক্ষে দায়ের করা মামলার অভিযোগ হুবহু মিলে গেছে। অথচ জবানবন্দীদাতাদের মধ্যে ১৮ জনই হাসপাতালটিতে কর্মরত। নানা কারণে তাদের নাম প্রকাশ করেননি তিনি। তবে রিপোর্টে তাদের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে। হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের জন্য তৈরি করা আইসোলেশন সেন্টারে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল না। বৈদ্যুতিক শর্টসাকিট থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটেছে বলে হাসপাতালটির তরফ থেকে যে দাবি করা হয়েছিল, বিদ্যুত বিভাগের এক্সপার্টরা তদন্তে তার কোন প্রমাণ পাননি। এ বিষয়ে তারা সুস্পষ্ট জবানবন্দীও দিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান মোতাবেক, এসি থেকেই আগুন লাগার বিষয়টি তারা দেখেছেন। এমন একটি হাসপাতালে নিম্নমানের এসি রাখা বা এসির মেইনটেনেন্স না করার বিষয়টি হাসপাতালের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। এমনকি আইসোলেশন সেন্টারে ফায়ার সার্ভিস নিশ্চিত করতে যে সনদ প্রয়োজন তা নেয়নি হাপসাতাল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে পাশ কাটিয়ে গেছে। এমনকি ফায়ার সার্ভিসকে হাসপাতালের তরফ থেকে না ডাকার কারণ এবং বিলম্ব করার বিষয়টিও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক রোগীর এক স্বজন জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসকে বিষয়টি অবহিত করেন। রাত সাড়ে নয়টায় আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে। ২৫ মিনিট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগুন নেভানোর চেষ্টা করেনি বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও রোগীদের স্বজনদের সাক্ষ্যে ওঠে এসেছে। এদিকে ঘটনার পর পরই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গুলশান মডেল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশনস্) শেখ শাহানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ওটাকে আইসোলেশন সেন্টার বলা যাবে না। আইসোলেশন সেন্টারের নামে সেখানে একটি অন্ধকার কুঠুরী তৈরি করেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য হওয়ায় কোনমতে একটি আইসোলেশন সেন্টার করেছিল। তাও আবার মাত্র পাঁচ শয্যা বিশিষ্ট। মূলত সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য হওয়ায় নামকাওয়াস্তে আইসোলেশন সেন্টার করা হয়েছিল। এই কর্মকর্তা বলছেন, নিহতদের মধ্যে রিয়াজুল আলম ও ভেরন এ্যান্থনী পল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না বলে হাসপাতালের টেস্ট রিপোর্টে আসে। অথচ হাসপাতালের তরফ থেকে দাবি করা হয়, নিহত পাঁচ রোগীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। নন কোভিড রোগীকে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে আইসোলেশন সেন্টারে লাইফ সাপোর্টে রাখার বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ তাদের মূল ভবনে নিয়ে লাইফ সাপোর্ট দেয়াছিল যুক্তিযুক্ত। কারণ তারা নন কোভিড রোগী। তদন্তে আইসোলেশন সেন্টারে লাইফ সাপোর্ট দেয়ার মতো যন্ত্রপাতি দেখা গেলেও নিহত রোগীদের লাইফ সাপোর্ট দেয়ার কোন তথ্য মেলেনি। এদিকে গত ৩ জুন রাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলাটি দায়ের করেন নিহত ভেরন এ্যান্থনী পলের মেয়ের জামাই রোনাল্ড নিকি গোমেজ। তিনিও মামলায় অগ্নিকা-ে পাঁচজনের মৃত্যুর জন্য হাসপাতালটির অবহেলা থাকার অভিযোগ আনেন। এ মামলায় হাসপাতালটির চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও, পরিচালক এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় আইসোলেশন ইউনিটে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের আসামি করেন তিনি। ঘটনার দিনই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের জানান, সিআইডির ফরেনসিক টিম হাসপাতালটি থেকে যে ১২টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বের করে আনে। যার মধ্যে আটটিরই মেয়াদ নেই। অগ্নিকা-ের ঘটনাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দারা তদন্ত করছে। পুলিশের তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যেই ৩৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডে চিকিৎসাধীন রোগীসহ ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল চেয়ে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রেদোয়ান আহমেদ রানজীব ও ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ হাইকোর্টে রিট করেছেন।
×