
মোরসালিন মিজান ॥ এত ব্যস্ত কর্মচঞ্চল ঢাকা হঠাৎ এমন স্থবির হয়ে যাবে, কেউ ভাবতে পারেনি। সকাল হতেই চাকরি ব্যবসা। অফিস আদালত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাসে ভিড়। গাদাগাদি। প্রাইভেট কার সিএনজি অটোরিক্সায় বসে যানজট ঠেলা। বার বার ঘড়ির দিকে তাকানো। সারাদিন এই করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা। তখনও সে একই ছবি। রাস্তাঘাটে মানুষ আর মানুষ শুধু। অথচ গত দুই মাসে সব যেন স্মৃতি হয়ে গিয়েছিল। রাজধানী শহরটাকে চেনা যাচ্ছিল না। কেউ কোথাও নেই। সব বন্ধ। তালা দেয়া। অতঃপর গত ৩১ মে থেকে কাজে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। ব্যস্ততা বাড়ছে। গতি পাচ্ছে ঢাকা। প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। ক্রমে চেনা চেহারায় ফিরবে রাজধানী, সব দেখে এমনটিই আশা করা হচ্ছে এখন।
করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণেই থমকে গিয়েছিল সব। গোটা বিশ^কেই তছনছ করে দিয়েছে প্রাণঘাতী ভাইরাস। সহসাই ঢুকে পড়েছিল বাংলাদেশে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সরকারী-বেসরকারী সব অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। এর পর দফায় দফায় বাড়ানো হয় ছুটির মেয়াদ। এ সময়ের মধ্যে বহু মানুষ ঢাকা ছেড়ে যান। বাকিরা বাসায় ঢুকে দরজায় খিল দেন। এভাবে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে সব কিছু। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? জীবিকা ছাড়াও তো জীবন বাঁচানো যাবে না। সরকার তাই সাধারণ ছুটি আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। গত ৩১ মে থেকে সীমিত আকারে খুলে দেয়া হয় সরকারী সব অফিস। মূলত এর পর থেকেই বদলাতে থাকে দৃশ্যপট। বর্তমানে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অফিস, কল কারখানা ইত্যাদি খুলে দেয়া হয়েছে। প্রায় একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় ঢাকার রাস্তায় নেমেছে গণপরিবহন। সীমিত আকারে বাস চলছে। যাতায়াত করছে মোটামুটি সব রুটেই। আছে মাইক্রোবাস সিএনজি অটোরিক্সা। এসবে করে অফিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে মানুষ। একইভাবে বাড়ি ফিরছে। এই আসা যাওয়ায় আগের মতো হুড়োহুড়ি, দৌড়ঝাঁপ নেই। অহেতুক গল্প আড্ডাও তেমন চোখে পড়ছে না। যার যে কাজ, সেটুকু সেরে স্থান ত্যাগ করতে দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে গাড়িতে ঠুকাঠুকি, বিত-া নেই। যানজট উধাও। তবে কর্মকা- যে চলছে, চারপাশে তাকিয়ে সেটি বোঝা যায়। একটা গতি আসতে শুরু করেছে। মতিঝিলে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কাজ করেন শফিকুর রহমান পরশ। দীর্ঘদিন পর আবারও কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি। বলছিলেন, বাসায় এতদিন থাকা হবে, থাকতে পারব কোনদিন ভাবিনি। বাইরের পৃথিবীর কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। ঢাকা শহরটাকে এতদিন টেলিভিশনে দেখেছি। আর যত দেখেছি ততই ভয় বেড়েছে। এখন অফিস খোলা। বের হচ্ছি। তবে বের হওয়ার পর বুকে একটু বল পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
দিলকুশায় অবস্থিত বিসিআইসি ভবনে কাজ করেন ইমতিয়াজ আলী। তিনিও দীর্ঘ ছুটি শেষে কাজে যোগ দিয়েছেন। অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বললেন, আমি ছুটির মধ্যেও বাসা থেকে মাঝে মধ্যে বের হয়েছি। বাজার করতে বের হতে হয়েছে। সুপারশপগুলোয় বেশ ভিড়। ভিড় ঠেলতে বাধ্য হয়েছি। তবে মুখে মাস্ক ছিল। হাত একটু পর পর স্যানিটাইজ করেছি। নিজ থেকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার চেষ্টা করেছি। ফলে এখনও সুস্থ আছি। বাজারের চেয়ে অফিসে ভিড় কম জানিয়ে তিনি বলেন, আমার অফিসে এখন উপস্থিতি এক তৃতীয়াংশ’র বেশি হবে না। অফিসে যারা আসেন তারাও নিজের টেবিলে বসেই কাজ করেন। এর ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে। এভাবে চালানো গেলে অত ঝুঁকিতে পড়তে হবে না বলেই বিশ^াস তার। নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ, হকার, দিনমজুররাও কাজ ফিরে পেতে মরিয়া। এখনও অনেকে সুবিধা করতে পারছেন না। তবে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলেই আশা তাদের। করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে কাঁঠালবাগানে একটি নির্মিয়মাণ ভবনে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন সোহাগ। কিন্তু এখনও সে কাজ শুরু হয়নি। তাই বলে বসে থাকলে তো চলবে না। বড় সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়া তরুণ বললেন, ‘ঈদের পর পর গ্রাম থাইকা আসছি। কিন্তু কাজ পাইতাছিলাম না। এখন কয়দিন ভ্যান চালাইতাছি। বিল্ডিংয়ের কাজ ধরলেই আর চালামু না। নিজের কাজে ঢুইক্যা যাইমু।’ এদিকে, ঢাকায় প্রবেশেও এখন কোন বাধা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিনই বিভিন্ন রুটে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে। ভাড়া বেশি। যাত্রী কম। তবুও ঢাকায় ফেরা থেমে নেই।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সবই এখন পরীক্ষামূলক। যারা কাজে ফিরেছেন তাদেরকে ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সব সরকারী আধাসরকারী স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী অফিস নিজ ব্যবস্থাপনায় সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি, অসুস্থ কর্মচারী এবং সন্তানসম্ভবা নারীরা কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকবেন। নির্দেশনা মানতে ব্যর্থ হলে এবং করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে প্রতীয়মান হলে আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে সব কিছু। তাই সব দিক মাথায় রেখে সতর্কতার সঙ্গে অফিস ও অন্যান্য কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।