ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্রান্ত ২১৮ জনের মধ্যে ১২৩ জনই রাজধানীর বাসিন্দা ;###;লকডাউন ৫৮ স্পট ;###;সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যায়নি ;###;কঠোরভাবে নিয়ম মানার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সবচেয়ে ঝুঁকিতে ঢাকা ॥ দেশে করোনা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৯ এপ্রিল ২০২০

সবচেয়ে ঝুঁকিতে ঢাকা ॥ দেশে করোনা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী ভাইরাস কোভিড-১৯ পাল্লা দিয়ে ছড়াচ্ছে বাংলাদেশেও। দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা। সামনের দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। জানা গেছে, দেশে মোট করোনা রোগীর অর্ধেকের বেশি এখন রাজধানীর। গত আট মার্চ থেকে একমাসে মোট আক্রান্ত ২১৮ জনের মধ্যে ১২৩ জনই ঢাকা সিটির। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বাইরে ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচজন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে রাজধানীর ৫৮টি স্পট লকডাউন করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি ওড়ানো হয়েছে লাল পতাকা। ৩০টির বেশি এলাকায় মিলেছে করোনার রোগী। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনা সংক্রমণের তৃতীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের গুচ্ছ আকার অতিক্রম করে অনির্দিষ্ট বাহকের মাধ্যমে অনির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না করতে পারায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকা কার্যত লকডাউন। রবিবার থেকে ঢাকায় প্রবেশ ও বের হওয়ায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে পুলিশ। জরুরী সেবা ছাড়া বন্ধ সকল প্রকার যানবাহন। ফলে রাজধানীজুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। বন্ধ আছে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সব ধরনের দোকানপাট বন্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মহানগর পুলিশ। তবে কাঁচাবাজার ও পাড়া মহল্লার দোকান চলবে সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। আর ওষুধের দোকান ও সুপারশপ খোলা থাকবে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। তারপরও ঢাকায় করোনা রোগী নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে গত ৪৮ ঘণ্টায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হওয়ায় রাস্তায় রাস্তায় অকারণে ঘোরাফেরা কমেছে। কিন্তু রাজধানীতে এত রোগী কেন? কি বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ^ স্বাস্থ্যসংস্থা বলছে করোনা রোধে সবচেয়ে বড় উপায় হলো টেস্ট, টেস্ট আর টেস্ট। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত পরীক্ষার পরিধি বাড়াতে পারিনি। সারাদেশে মাত্র ১৬টি ল্যাবে পরীক্ষা চলছে। তাও সীমিত আকারে। গণহারে পরীক্ষা হচ্ছে না। যারা উপসর্গ নিয়ে হটলাইনে টেলিফোন করছেন তাদের মধ্যে কিছু মানুষ পরীক্ষার আওতায় আসছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে আক্রান্ত রোগীদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা করা হয়েছে এমন নজির আছে বলে জানা নেই। তিনি বলেন, রাজধানীতে পরীক্ষা বেড়েছে। তাই আক্রান্ত বেশি মনে হচ্ছে। সবখানে যতবেশি পরীক্ষা হবে ততটা সে এলাকার চিত্র ফুটে উঠবে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি বিমান চলমান অবস্থায় শেষ দুই সপ্তাহে প্রচুর মানুষ দেশে এসেছেন। আক্রান্ত দেশ থেকে অনেক প্রবাসী এসে ঢাকায় উঠেছেন। এরপর অনেকে গ্রামে গেছেন। যার প্রভাব ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। যাকে বলা হয় কমিউনিটি ট্রান্সমিশনে আরেকধাপ এগিয়ে থাকা। তাই সবাইকে সতর্ক হতে হবে। ঘরে থাকতে হবে। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে নয়। তাহলে সংক্রমণ কমবে। অন্য সূত্র বলছে, গত তিনমাসে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছেন প্রায় সাতলাখ মানুষ। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের আগ পর্যন্ত আক্রান্ত দেশগুলো থেকে এসেছে মানুষের ¯্রােত। যাদের একটা বড় অংশ ঢাকায় অবস্থান করেন। যারমধ্যে ক্লাস্টার এলাকা হিসেবে মীরপুরের টোলারবাগ ও বাসাবো এলাকাতেই আছে কয়েক শ’ প্রবাসী। বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরেছেন তাদের প্রত্যেকের কোয়ারেন্টাইন শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। আবার অনেকে ঢাকায় কিছুদিন থেকে গ্রামে ফিরেছেন। তাছাড়া বিদেশ থেকে আসা চিকিৎসা সরঞ্জামসহ অন্যান্য পণ্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই খোলা হওয়ায় এ থেকে যে কেউ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) জনকণ্ঠ’কে বলেন, রাজধানীতে ঘনবসতি বেশি। ঢাকা থেকে একযোগে মানুষ বের হওয়া ও ফিরে আসার পর অবাধে চলাফেরা আমরা লক্ষ করেছি। সামাজিক দূরত্ব মোটেও নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে ভাইরাসটি দ্রুত সবার মধ্যে ছড়াচ্ছে। দিন দিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক সিটিতে এই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। মূল কারণ হলো ঘনবসতি। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রাজধানীতে বসবাস করে। তাই শুরু থেকেই সংক্রমণ প্রতিরোধে আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিল। করোনা বিস্তার রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া পদক্ষেপগুলো কঠোরভাবে পালনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখেন তাহলে সামনের দিনগুলো মোটেই সুখকর নয়। এজন্য সবাইকে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। চীন থেকে উৎপত্তি এই ভাইরাস এখন সীমানা পেরিয়ে দেশে দেশে। বিশ^ব্যাপী বাড়ছে প্রতি মূহুর্তে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের ভয়ে থরথর করে কাঁপছে গোটা বিশ^। দুনিয়ার বাঘা বাঘা নেতা, বিজ্ঞানীরাও রীতিমতো অসহায় কোভিড মোকাবেলায়। সবাইকে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ নিয়ে সবার কপালে যেন দুশ্চিন্তার রেখা। খোদ বিশে^র শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকাও ধরাশায়ী করোনার কাছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিষেধকের জন্য ভারতকে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। সর্বশেষ আমেরিকার পক্ষ থেকে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাকে হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। বলেছেন, আর্থিক অনুদান কমিয়ে দেবেন আন্তর্জাতিক এই স্বাস্থ্য সংস্থাটিতে। বুধবার পর্যন্ত বিশে^র ২০৫টির বেশি দেশে ছড়িয়েছে নোভেল করোনাভাইরাস। এতে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ। সুস্থ হয়েছেন তিন লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ৮২ হাজারের বেশি। দেশে এক দিনেই ৫৪ জনের মধ্যে নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা এক লাফে বেড়ে ২১৮ জন হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে, তাতে দেশে কোভিড-১৯ এ মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ জন। ঠিক এক মাস আগে আট মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো কারও দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এক দিনে আক্রান্তের এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা। আক্রান্তদের মধ্যে মোট ৩৩ জন এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এই সবশেষ তথ্য তুলে ধরেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক দেশে সংক্রমণ শুরুর একমাস পর ব্যাপক মাত্রায় ছড়াতে দেখা গেছে। এক পর্যায়ে তা মহামারী আকারে গিয়ে ঠেকে। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ সংক্রমণের একমাস পার করে এক দিন আজ। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ছাড়িয়ে যাওয়ার পর সামনের দিনগুলো খুব একটা সুন্দর হয়ে আসবে না একটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে অনেক দেশ এই পরিস্থিতিতে জরুরী অবস্থা, লকডাউন বা কার্ফু জারি করেছে।
×