ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইভিএমে ভোট ॥ জ্ঞাননির্ভর রাষ্ট্র ও সমাজ

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ইভিএমে ভোট ॥ জ্ঞাননির্ভর রাষ্ট্র ও সমাজ

সদ্যসমাপ্ত ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে নানারকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। এবার ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণে একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যের ছাপ ছিল। নেতিবাচক-ইতিবাচক বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও এটা যে আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক একটি পদ্ধতি, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের এটাকে অন্যতম একটি শর্তও স্বীকার করতে হবে। প্রথমদিকে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। এর ব্যবহার টেকসই করার জন্য আরও সতর্ক হতে হবে। তবে, দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের পথে, সে বিশ্লেষণের অন্যতম অনুষজ্ঞ ইভিএম ভোটিং পদ্ধতি। প্রায় সব দলের অংশগ্রহণ, সেই সঙ্গে প্রচারে লেভেল প্লেয়িংয়ের কোন ঘাটতি ছিল না দুই সিটি নির্বাচনে। প্রধান দুটি বড় রাজনৈতিক দল ও ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ব্যাপক শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। অবশ্য প্রচার অনুযায়ী ভোটের দিন ভোটাধিকার প্রয়োগে ভোটার উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। গড়পড়তা মাত্র ২৮% ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। ৭২%-এর অনুপস্থিতিতে ভোটের প্রতি অনাগ্রহকেই দায়ী করা হচ্ছে। এই অল্পসংখ্যক ভোটারের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুরুত্বহীন প্রতিনিধি হিসেবে মন্তব্য করছেন কেউ কেউ। কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণে কারও মৌলিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটছে না। বিএনপি একে কারচুপি ও প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবে, তার কোন প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হয়নি। ইভিএম পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থাটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক। এতে কারচুপির ন্যূনতম সুযোগও নেই। মেশিনারি যন্ত্র দিয়ে ভোট নেয়া হয়েছে। মেশিন কখনও কারচুপি করতে পারে না। এদিকে যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, তাদেরও কারচুপি করে ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে ভোট প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও কোনরকম কারচুপি, জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। এ পদ্ধতিতে কোনক্রমেই অনিয়ম করার সুযোগ নেই। ইচ্ছা করলেও পারবে না। ভোটের স্বচ্ছতায় কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। এদিকে ভোটার উপস্থিতি কম বলে কেউ কেউ গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত বলেছেন। তাদের উদ্বেগের কোন যৌক্তিকতা আছে বলেও মনে করি না। ভোটাধিকার প্রয়োগ যেমন গণতান্ত্রিক অধিকার, না করাও গণতান্ত্রিক অধিকার। কেউ যদি ভোট দিতে না যায় তার অর্থ এই নয় যে, তিনি কাউকে সমর্থন করেন বা করেন না। স্বল্পসংখ্যক ভোটে নির্বাচিতরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করেন না বলে যারা প্রচার করছেন, তাদের ধারণাও ভুল। যদি তাই হতো তাহলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে রাজপথে নামত কোন নেতৃত্ব ছাড়াই। তাই বুঝতে হবে, নির্বাচিতদের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও সেটারই প্রমাণ মেলে। উন্নত দেশগুলোতেও ২০%-২২% এর বেশি ভোটাধিকার প্রয়োগ হয় না। সমৃদ্ধশালী দেশের মানুষ আত্মসচেতনতার জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ভোট দেয়া না দেয়াটা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। জনগণের মৌন সমর্থনই আসল কথা। তবে তৃতীয়বিশে^র দেশগুলোতে কমসংখ্যক ভোটাধিকার প্রয়োগের কিছু কারণ রয়েছে। আর তা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদাসীনতা। রাজনৈতিক নেতারা যদি সাধারণ নাগরিককে ভোটদানে উৎসাহী করে তুলতে না পারে, সে ক্ষেত্রে ভোটারগণ ভোটদানে বিরত থাকে- এটাই স্বাভাবিক। বেশিমাত্রায় ভোটার উপস্থিতির কৌশলটা যদি নেতারা না জানে তবে এমন অবস্থা হবেই। তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। অত্যাধুনিক, বিজ্ঞান সভ্যতার এই যুগে মানুষের মনমানসিকতারও পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে আমরা যদি সত্যসত্যই একবার বিশ^াস করি যে, আমাদের ভবিষ্যত হলো অধিকতর সাফল্য ও মানব সমাজ কর্তৃক কীর্তির পরিপূর্ণতা অর্জনের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা, তাহলে প্রথাগত ব্যঞ্জনার প্রয়োজন বলতে যা বোঝায় তা গৌণ হয়ে পড়ে। ভোটের ক্ষেত্রেও সেটি ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক নেতাদের হতে হয় কর্মকুশলী। কর্মকুশলতায় দক্ষতার দুটি মাত্রা থাকেÑ একটি হচ্ছে, পরিমাণ বা সংখ্যা। অন্যটি হচ্ছে গুণগতমান। এ দুটো দর্শনকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হয়। ভোটের পরিমাণ কমবেশির চাইতেও পদ্ধতির গুণগতমান কতটা উন্নতি হয়েছে, সেটার বিশ্লেষণ দরকার আগে। বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ- এরা যদি যথেষ্ট খেতে পায়, উপযুক্ত শিক্ষা পায়, সর্বসুবিধাযুক্ত বাড়িতে বসবাস করে; তবে তা হবে একটি চমৎকার উন্নতির লক্ষণ। বাংলাদেশে যেটি অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়েছে। কয়েকদিন আগে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের প্রতিথযশা অনেক সাংবাদিক-কলামিস্ট বন্ধুর সাক্ষাত ঘটেছিল অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিক রাহুল রাহার গাড়িতে করে ফিরছিলাম বাসার উদ্দেশে। সাংবাদিক বন্ধু বয়সে আমার ছোট হলেও প্রজ্ঞায় বড়। আমি তাকে সম্মান করি। পথিমধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু কথা হয় তার সঙ্গে। একান্ত আলাপচারিতায় মনে হলো, রাহুল রাহা আধ্যাত্মিক অনুভূতিপ্রবণ বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তিনি বললেন ‘রাষ্ট্রকে জ্ঞাননির্ভর করতে যা করা দরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটিই করছেন। মানুষকে ভালভাবে জানার নাম-ই জ্ঞান, আর না জানার নামই অজ্ঞান। মানুষকে ভালভাবে জানতে পারলে ঈশ^র বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। অন্যভাবে ঈশ^রকে জানার নামও জ্ঞান না জানার নাম অজ্ঞান। শেখ হাসিনা তা জেনেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন।’ তিনি এও বললেন, বর্তমান সমাজে একশ্রেণীর মানুষ জানে না যে, সহায়সম্পদের আধিক্য তার ক্লান্তি এবং অশান্তি দূর করতে ব্যর্থ হবে। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে সে বার্তাটি পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছেন। তার কথাগুলো শুনে আমি প্রীত হয়েছি। রাষ্ট্রের বা সংসারের উন্নতিতে জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। জ্ঞান কাজে লাগাতে পারলে সাফল্যও অনিবার্য। আমরা বিজ্ঞানের এ জগতে দেখতে পাইÑশুদ্ধ বিজ্ঞান আর ফলিত বিজ্ঞান। অর্থনীতি ও পরিবেশের উন্নতির ফলে জ্ঞান রূপায়িত হচ্ছে পণ্যে। আমাদের গ্রামের লোক যদি ভাল শিক্ষা, মাধ্যমিক পর্যন্ত না হলেও অন্তত অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শতভাগ শিক্ষা লাভ করে তবে সারাদেশই উন্নত হয়ে উঠবে। আমাদের এ লক্ষ্য কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে। এখন দরকার গভীর চিন্তা ও কঠোর পরিশ্রম। বিনাশ্রমে বিত্তশালী হওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে। সেটা সম্ভব সকল নাগরিকের যোগী হওয়ার মাধ্যমে। হৃদয়ের অন্তরস্থ শক্তিগুলোতে আনুপাতিক হারে নতুনত্ব আসবে। এ গুলো হচ্ছে আধ্যাত্মিক উন্নতি। এ উন্নতি কাজের ক্ষেত্রকে যেমন বিকশিত করবে, তেমনি মানবিক মূল্যবোধকেও জাগিয়ে তুলবে। সবকিছুই নির্ভর করবে ব্যাপকভাবে নানা বিষয়ে জানার মধ্য দিয়ে। দেশ স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সহজ-সরল ভাষায় অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁর বক্তব্যকে হৃদয়ে ধারণ করে যদি কর্তাসাহেবরা দায়িত্ব পালন করেন, তবে কোন বাধাই রাষ্ট্রকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব এখানেই। তিনি আপামর মানুষকে কাছে টেনে নিতেন। জ্ঞানের ব্যাপকতা নিয়েই শেখ হাসিনা এগিয়ে যাচ্ছেন সমস্ত বাধা অতিক্রম করে। বাংলাদেশ যেন সর্বাত্মক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে পারে। প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞান আমাদের কাম্য। এরূপ জ্ঞানকে বলা হয় প্রজ্ঞান বা শুদ্ধবুদ্ধি। শুদ্ধবুদ্ধির রাজনীতিকদের আধিক্য ঘটুক, এটা জনগণের মনের আকাক্সক্ষা। মুজিববর্ষে রাজনীতিকদের মধ্যে জ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের চেতনা জেগে উঠুক। বৈশ্বিক রাজনীতির পরিম-লে শেখ হাসিনার অবস্থান সৃদৃঢ় হয়েছে। এই দৃঢ়তার নেপথ্যে তাঁর প্রজ্ঞা। সুতরাং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যারা আছেন, তারাও প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠুক জানার মাধ্যমে। তবেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব। লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক [email protected]
×