ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

মানবতার অনন্য বাতিঘর

প্রকাশিত: ১২:১১, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

মানবতার অনন্য বাতিঘর

পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত মানুষের জন্ম হয় আবার একটি নির্দিষ্ট সময় পর পৃথিবী থেকে বিদায়ও নেয়। এর মধ্যে কিছু মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে চার পাশটাকে আলোয় ভরিয়ে রাখে এবং সেই আলোয় পরের প্রজন্মকেও পথ চলতে বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আজকে তেমনই একজন মানুষের কথা বলতে চাই যিনি আজীবন মানব সেবা করে চলেছেন। একদিকে তিনি একজন নারী আবার অন্য দিকে ভিনদেশী। মানবতার সেবায় নিয়োজিত হতে গিয়ে লিঙ্গভেদ, মানচিত্র, দেশ, কাল, স্থান তাঁকে এতটুকু আলাদা করতে পারেনি। এই মানুষটি হচ্ছেন মানবতার সেবায় এক অনন্য মানুষ মহীয়সী ভেলেরী অ্যান টেইলর। যাকে এখন আমরা আমাদের মানুষ বা বাংলাদেশের নাগরিক বলতেও গর্ব বোধ করি। ভেলেরী এ্যান টেইলর-এর জন্ম ১৯৪৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের বাগান খ্যাত কেন্ট শহরে। পিতামাতা উইলিয়াম টেইলর-মেরি টেইলর দম্পতির তিন মেয়ের মধ্যে ভেলেরী দ্বিতীয় সন্তান। খুব ছোট বেলার কিছু সময় অর্থাৎ ৩ থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত গির্জার পুরোহিত বাবার কাজের প্রয়োজনে পরিবারের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় বসবাস করেছেন। ৫ বছর বয়সে আবারও ফিরে আসেন কেন্ট শহরে। ৮ বছর বয়সে এক বোর্ডিং স্কুলে পড়তে যান। সেখানে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত লন্ডনে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে পড়ালেখা সম্পন্ন করেন। ভেলেরী টেইলর পড়ালেখা শেষ করার পর লন্ডনেই ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করেন। ২ বছর পর ১৯৬৯ সালে ফিজিওথেরাপি প্রদানের উদ্দেশ্যে ‘ভলান্ট্যারি সার্ভিস ওভারসীজ (ভিএসও)’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান মিশনারী হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। এখানে ২ বছর কাজ করার পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন মাস বাকি থাকতেই সেপ্টেম্বর মাসে আবারও ফিরে আসেন যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশে। তারপর যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। কারণ যুদ্ধের কারণে পুঙ্গত্বের হার বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। তিনি সফলভাবেই একাজ করতে সমর্থ হন। নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর তিনি আরও ২ বছর এদেশে থেকে তার কাজ চালিয়ে যান। ভেলেরী ততদিনে এদেশের মাটি ও মানুষের মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন। মনে মনে স্বপ্ন বুনতে থাকেন এদেশের মানুষের জন্য; মানবসেবার জন্য একটা কিছু করতে হবে। ১৯৭৩ সালে মানবসেবার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটি স্বার্থক ফিজিওথেরাপি সংগঠন তৈরির জন্য উপযুক্ত অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করার জন্য আবারও ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ভেলেরী টেইলর ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে আবারও আসেন। ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে যোগদান করেন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে প্রায় চার বছর স্বাভাবিক রুটিন কাজকর্মেই কেটে যায়। ১৯৭৯ সালে অনেক কষ্ট ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই হাসপাতালেরই দুটি পরিত্যাক্ত গুদামঘর পান। এখানেই প্রথম ছোট্ট আকারে ৪ জন রোগী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ফিজিওথেরাপির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসান কেন্দ্র (সিআরপি)’। প্রতিষ্ঠার পর অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন এর উন্নতির জন্য। সাইকেলে চেপে বিভিন্ন জনের ঘরে ঘরে যেতেন সাহায্যের জন্য। এজন্য তাঁকে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে প্রতিষ্ঠার প্রথম ১১ বছর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে ধানমন্ডির শংকর; শংকর থেকে ফার্মগেট এভাবে ৩ জায়গায় স্থানান্তর হতে হয়। অবশেষে ১৯৯০ সালে ঢাকার সাভারে নিজস্ব জায়গায় মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা হয়। ধীরে ধীরে এর পরিসর বাড়তে থাকে। বর্তমানে সাভারের প্রধান কার্যালয় সহ গণকবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ঢাকার মিরপুর ও নবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, মৌরভীবাজার সদর, মৌলবীবাজারের গোবিন্দপুরে সিআরপির ১০টি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবছর ৫০ হাজারেরও অধিক মানুষ এই প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পাচ্ছেন। প্রচ- ইচ্ছা শক্তি কোন মহৎ কাজকে যে দমিয়ে রাখতে পারে না ভেলেরী তাঁর প্রকৃষ্ট উদহারণ। মহীয়সী ভেলেরী বাংলাদেশের পঙ্গু দরিদ্রদের জন্য কিছু করতে চেয়েছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের উন্নত চিকিৎসা ও পরবর্তিতে কর্মসংস্থানের এক মহৎ লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরে তিল তিল করে তৈরি করেছেন সিআরপি। সম্পূর্ণ আপন প্রচেষ্টায় একটি পূর্ণাঙ্গ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তিনি বিশ্বে এক বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একজন ভেলেরী টেইলরকে আমরা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, জোয়ান অফ আর্ক, মাদার তেরেসা কিংবা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতো মহীয়সী নারীদের কাতারে দাঁড় করাতেই পারি। ভেলেরীর দেখানো স্বপ্নে ক্রমশ এদেশের মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মাতে থাকে এক অদ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিআরপি বাংলাদেশের দরিদ্র, পুঙ্গ মানুষের জন্য খুলে দিয়েছে এক অপার সম্ভাবনার দিগন্ত। ভেলেরী টেইলর তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন সময় পেয়েছেন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পদক, আর্থার আয়ার স্বর্ণপদক, ইংল্যান্ডের ইয়োর্ক এসটি জন ইউনিভার্সিটি কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ওয়ান এ্যাওয়ার্ড, স্বাস্থ্যসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকার এই মহীয়সী নারীকে প্রদান করে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয় তাঁকে। এছাড়াও দেশে-বিদেশে আরও অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা এবং স্বীকৃতিও অর্জন করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে ভেলেরী টেইলর সংসার করেননি। তবে ভেলেরীর জয়তি ও পপি নামে ২ পালিত কন্যা রয়েছে। তাছাড়া ‘সিআরপি’ প্রতিষ্ঠানটিই এখন ভেলেরীর পরিবার, সংসার। সিঅরপিকে নিয়েই তাঁর এতগুলো বছর পার হয়েছে। বাকি জীবন ‘সিআরপি’র সঙ্গেই তিনি সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় কাটাতে চান। সিআরপির মতো একটি প্রতিষ্ঠান এবং ভেলেরী টেইলরের মতো ক’জন ব্যক্তিত্বের কাজের মূল্যায়ন করার ধৃষ্টতা দেখানো একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আজ আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হতে চলল কিন্তু এত দিনে সিআরপির মতো একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান এবং ভেলেরীর মতো একজন অনন্য ব্যক্তিত্বের এখনও জন্ম হয়নি এই দেশে। সারাদেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর একটি সিআরপি কিংবা আর একজন ভেলেরীর সন্ধান মেলে না। আজকে ভাবতে বাধ্যই হতে হয় সেদিন যদি ভেলেরী সিআরপির মতো প্রতিষ্ঠান গড়বার উদ্যোগ না নিতেন তাহলে বিপুল পরিমাণ অসহায় পঙ্গু দরিদ্র জনগোষ্ঠী কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? উত্তর মিলানো খুব কঠিন। একটি উন্নত দেশে জন্ম নেওয়া ভেলেরী চাইলে সেখানেই আয়েশি জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু না সকল প্রকার আরাম আয়েশকে তুচ্ছ করে তৎকালীন বিশ্ব মানচিত্রে সদ্য স্বাধীন এবং বিশে^র অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশের মানব সেবায় এগিয়ে এসেছেন। এ দেশের আসহায়, পুঙ্গ, প্রতিবন্ধী, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জীবন মান উন্নয়নে এই মানুষটির অবদান অসামান্য। মানব কল্যাণে ভলেরী টেইলর এক বাতিঘর। যে বাতিঘর নিরন্তর আলো দিয়ে চলেছে। ভেলেরীর আমাদের নারী পুরুষ সকলের জন্য অনন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি এই মহীয়সী নারীর ৭৭তম জন্মদিন। তিনি আরও দীর্ঘদিন তাঁর কর্মের আলোয় আমাদের চারপাশটাকে আলোকিত করুন সেই শুভ কামনা।
×