ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাপী নতুন আতঙ্ক ‘করোনা ভাইরাস’

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

বিশ্বব্যাপী নতুন আতঙ্ক ‘করোনা ভাইরাস’

প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা যুদ্ধবিগ্রহ এমন কিছু নয়, পৃথিবীজুড়ে এখন নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে করোনা ভাইরাস। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হলেও তা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে খুব দ্রুত। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে ইতোমধ্যে প্রায় ১৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার জানা গেলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। তবে সেটা কতটা মারাত্মক হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। করোনা ভাইরাস হলো একটি আরএনএ ভাইরাস। সাধারণত পশু-পাখির মধ্যে এই ভাইরাস দেখা যায়। তবে মানুষ যদি ভাইরাস আক্রান্ত পশুপাখির সংস্পর্শে যায় বা অপরিচ্ছন্ন মাংস খায় তাহলে এই ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে। মাঝে মাঝে এই ভাইরাস ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। হয়তো অনেকের মনে আছে, ২০০২ থেকে ২০০৩ সালে বিশ্বের ৩৭টি দেশে ‘সার্স’ ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৫-১৭ সালে মিডল ইস্ট বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ছড়িয়ে পড়ে ‘মার্স’। এগুলো করোনা ভাইরাসের প্রভাবে হয়েছিল। এবার চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস, আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য ও শক্তিশালী হয়ে। এর নাম দেয়া হয়েছে নোভেল করোনা ভাইরাস। চীনের হুনানে মাংস, মাছের পাইকারি বাজার থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল সাত রাজ্যে বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছে। কিন্তু কী এই করোনা ভাইরাস? এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ আছে কি? কিভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা সম্ভব জানাচ্ছেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বিশ্বাস। করোনা ভাইরাস এটা লাতিন শব্দ। যার অর্থ ক্রাউন। এই ভাইরাসের ইনফেকটেড অংশ ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ অনেকটা রয়্যাল ক্রাউনের মতো দেখায়। তা থেকেই নাম কোরোনা বা করোনা ভাইরাস। কিভাবে বুঝবেন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন- সর্দি, কাশি, জ্বর হতেই পারে। তার মানে এই নয় সেটা করোনা ভাইরাসের জন্য। তবে জ্বর, সর্দি, কাশি হওয়ার পর যদি খুব কম সময়ে শ্বাসকষ্ট ভীষণভাবে বেড়ে যায় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে। উপসর্গ হিসেবে বলা যায়, সর্দি, কাশি, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, জ্বর, গলাব্যথা। ভাইরাস আক্রমণ করে ফুসফুসে। সর্দি, কাশি থেকেই সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কেউ কাশলে থুথু ছিটকায় অনেক দূর পর্যন্ত। দ্রুত গতিতে সেক্ষেত্রে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। নাক মুছে সেই হাতে কোন জিনিস ধরলে সেই জিনিস যদি কোন সুস্থ মানুষ ধরেন তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন। এখন বাংলাদেশের সব জায়গায়ই জনমনে আতঙ্কÑ কখন কিভাবে আবার ভাইরাসটি এদেশে না ছড়িয়ে পড়ে! অবশ্য এই আশঙ্কা কোনভাবেই ফেলে দেয়ার মতো নয়। এদিকে সংখ্যার হারে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বিশাল একটি অংশ ইতোমধ্যেই চীনের হুবেই প্রদেশে আটকা পড়েছে। তাই বেড়েছে উদ্বেগ, বেড়েছে পরিবারগুলোর দুশ্চিন্তা। কিন্তু এই দুশ্চিন্তা কোন সমাধান নয়। জনসাধারণকে আত্মবিশ্বাসী ও সচেতন করে তুলতে হবে। কারণ এই ভাইরাসের মোকাবেলায় প্রয়োজন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। এ প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে ভাইরাসটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। ঈড়ৎড়হধ শব্দের অর্থ জ্যোতির্বলয়। এ ভাইরাসটি সূর্য থেকে ছিটকে পড়া আলোকরশ্মির মতো বলে এর নামকরণ করা হয় করোনা ভাইরাস। মানুষ ও পশু-পাখি এই ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলেই ঘাবড়ে যাওয়া যাবে না। কারণ সর্দি-কাশি মানেই করোনা ভাইরাস নয়। সুতরাং ঘাবড়ে না গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। করোনা ভাইরাস মূলত শ্বাসযন্ত্রের নিচের অংশ শ্বাসনালী ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। এর ফলে বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ নিউমোনিয়া ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। প্রথমত, এ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আত্মসচেতন হতে হবে। ভাইরাসটি নতুন হওয়ায় সরাসরি কোন চিকিৎসা না থাকলেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চললে খুব সহজেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে এই ভাইরাসকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মানুষকে নিয়মিত হাত ভালভাবে ধোয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা এবং ঠাণ্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকারও পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। যেমনÑ ম্ম্বুাই, হংকং, ওয়াশিংটনে। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ থামিয়ে যখন বিশ্বজুড়ে আর্থিক বৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলছিল ঠিক তখনই আবার করোনা ভাইরাস চীনে সংক্রমিত হওয়ায় সেই আশায় যেন জল ঢেলে দিল। ইতোমধ্যেই চীন থেকে ১৯টি দেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলে খবরে প্রকাশ। তাছাড়া অন্যত্র এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দানা বেঁধেছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তা লক্ষ্য করে বিশ্বজুড়ে লগ্নিকারীরা শেয়ার বেচে তুলনায়মূলক নিরাপদ কোন ক্ষেত্রে সেই অর্থ সরিয়ে নিতে চাইছেন। তারা আশঙ্কা করছেন এই করোনা ভাইরাসের জেরে দুনিয়াজুড়ে মন্দা নেমে আসতে পারে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের দেয়া তথ্য অনুসারে দেশের ৩১টি প্রদেশে আজ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ৯৭৪ জনে দাঁড়িয়েছে, যা সার্স ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার চেয়েও বেশি। আর চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে আরও ১৯ জায়গায় অন্তত ৭০ জনের দেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৫ জনে। এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ ঠেকাতে এরই মধ্যে উহান ও আশপাশের ১৬টি শহরে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে চিনের কর্তৃপক্ষ। অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের অর্থনীতি রীতিমতো ঝুঁকির মুখে পড়বে যদি আগামী কয়েক সপ্তাহে করোনা ভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়ে। এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সেটা নির্ভর করছে চীনের উহান শহরে এই মহামারী কত তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ওপর। এমএসসিআই ওয়ার্ল্ড ইন্ডেক্স যা ২৩টি বাজারকে সূচিত করে এবং তা গত দশ দিনে ১.৩ শতাংশ কমেছে। এই সময়ে ভারতের সেনসেক্সকেও প্রায় ২ শতাংশ নামতে দেখা গেছে। তাছাড়া সেনসেক্স ৪৬ শতাংশ নিচে নামে। তবে ভারতে শেয়ার বাজারের অবস্থা কিছুটা ভাল। তবে এদিন দুপুর আড়াইটা নাগাদ সেনসেক্সের অবস্থা বরং ভাল ছিল। ওই সময় গত দিনের তুলনায় ২৫০ পয়েন্ট উপরে ছিল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের লগ্নিকারীরা করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে সামনেই আবার সাধারণ বাজেট। ফলে সেদিকে অনেকেই তাকিয়ে রয়েছেন। বাজেটে কি ঘোষণা হয় তার ওপর নির্ভর করছে বিনিয়োগকারীদের মনোভাব। ইতোমধ্যেই চীনের রাষ্ট্রপতি সি জিংপিং আশ্বাস দিয়েছেন করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করার। তবে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সতর্কের ঘণ্টা বেজে গেছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের সেখান থেকে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দু’ভাবে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা হতে পারে। এক থ্রোট সোয়াব পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা। আর একটি উপায় রক্ত পরীক্ষা। এছাড়া এলাইজা পদ্ধতিতে দেখা যেতে পারে করোনা ভাইরাস পজিটিভ কিনা। যেহেতু এই ভাইরাস একেবারেই নতুন, তাই নির্দিষ্ট কিট বা পরীক্ষা পদ্ধতি সম্ভবত এখনও এ রাজ্যে নেই। পুনার ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে এ নিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে পারে। করোনা ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক বা নির্দিষ্ট ওষুধ তৈরি হয়নি। সতর্কতা হিসেবে এই ভাইরাস নিয়ে এখনই এদেশে চিন্তার কোন কারণ নেই। করোনা ভাইরাসের কোন কোন স্ট্রেন মিউটেশন হতে পারে। এমনটা প্রায়ই হয়। সেই মিউটেট হওয়া ভাইরাসগুলোই চিন্তার। কারণ, সেগুলো বেশি শক্তিশালী হয়। অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণে ফুসফুস পুরোপুরি সাদা হয়ে যায়। এ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম দেখা দিলে প্রাণহানির সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবে এমনিতে কোন ভয় নেই। জ্বর, সর্দি, কাশি হলে বিশ্রাম নিন। বেশি করে জল খান। একটু আলাদা ঘরে থাকুন। শ্বাসকষ্ট বাড়লে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এক্ষেত্রে যেহেতু প্রথমেই বোঝার উপায় নেই এটা করোনা কিনা, তাই সংক্রমণ ঠেকাতে যিনি রোগীর সেবা করবেন তার সতর্ক থাকা দরকার। এছাড়াও এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। রোগীর ঘরে গেলে তারপর সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হবে। হাত ধোয়ার আগে তা মুখে, নাকে দেয়া যাবে না। সংক্রমণ ঠেকাতে বারবার ভাল করে হাত ধুয়ে নিন। বারবার হাত নাকে, চোখে, মুখে দেবেন না। খাওয়ার আগে হাত ধুলে এমনিতেই অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে, বিশ্বে সাড়ে ৬ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে এই মারাত্মক ভাইরাস। চীন থেকে উত্থান হওয়া ভাইরাসটি ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইসরাইলসহ চীনের পাশর্^বর্তী বেশ কিছু রাষ্ট্রে। আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যার হার বিশ্ববাসীকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ইতোমধ্যে সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশও ঝুঁকিমুক্ত নয় এই মহামারী ভাইরাসের হাত থেকে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাদের সতর্কতার বিকল্প আর কিছুই করার নেই। ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স
×