ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আশিতম জন্মদিনে মনিভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯

আশিতম জন্মদিনে মনিভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা

* সেমিনার * ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট * ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাকান্ডের আগের দিন * স্থান- সেগুনবাগিচা বাকশাল কার্যালয় * প্রধান আলোচক- প্রফেসর ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী (উজ. গঅঈ) * মূল আলোচক- শেখ ফজলুল হক মনি (বাকশাল সেক্রেটারি) * আলোচ্যসূচী- কে উপরে- বাকশাল ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি না ডিস্ট্রিক্ট গবর্নর? গবর্নরের গাড়িতে পতাকা থাকলে সেক্রেটারির গাড়িতে থাকবে না কেন? আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে মোটামুটি সেটেল্ড। সাংবাদিকতাই করব মনস্থির করে ফেলেছি। তখন চাকরির কোন অভাব ছিল না। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। সমস্ত বিভাগে দেদার ভ্যাকেন্সি, সরকারী-বেসরকারী উভয় খাতে। তাছাড়া চাকরির বাজারে আমাদের জেনারেশন সবচেয়ে লোভনীয়, সবচেয়ে দামী। মুক্তিযোদ্ধা হলে তো কোন কথাই নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যদি বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর সদস্য হয় তবে তো সবার উপরে। আমার চাকরির জন্য কোন তদ্বির, কোন স্যান্ডেল ক্ষয় করার ব্যাপার ছিল না। আমি সবার উপরের দলে ছিলাম। ঐসব কিছুর মধ্যে সাংবাদিকতা পেশাটাই ভাল লাগল। এ পেশায় অর্থ, ক্ষমতা আর যাই হোক; মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে দঁড়ানো যায়, উঁচু গলায় কথা বলা যায়, যখনতখন যে কোন সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে অথবা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু এই সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার কম হয় না। আজকাল তো দেদার চলছে অপব্যবহার। এখন খবরের জন্য দৌড়ানোর চেয়ে পেট ভরানোর জন্যই দৌড়ায় বেশি। এরাই আবার পলিটিশিয়ানদের সমালোচনা করে ততোধিক। তার পরও এই পেশাটাকে বেছে নিলাম। হয়তবা দেশের সর্বাধিক প্রচারিত এবং সবচেয়ে ক্রেডিবল নিউজ পেপারের চাকরি বলেই। মনে পড়ে, ঢাকার বাইরে এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে গেলে তরুণ-তরুণীরা আমাদের অটোগ্রাফ নিত। ১৯৭৪ সালের কথা। শাহজাদপুর কুঠিবাড়ীতে সেবার রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপনের আয়োজন করে সরকার। প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেন বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জ তথা গোটা উত্তরবঙ্গ তথা গোটা বাংলাদেশের কৃতী সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত প্রিয় সহযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু হত্যার ৭৭ দিন পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত ৪ জাতীয় নেতার অন্যতম শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। তখন যোগাযোগমন্ত্রী। বেতার-টিভিসহ একদল সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। এক সকালে একদল তরুণ এসে আমাদের অটোগ্রাফ নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। দৈনিক বাংলা থেকে গিয়েছিলেন আব্দুল করিম ভাই (মরহুম)। আমি তাকে দেখিয়ে দিয়ে বললাম- উনি বড় সাংবাদিক, ওনার অটোগ্রাফ নিতে পার। কিন্তু না, তারা ইত্তেফাকের সাংবাদিকের অটোগ্রাফ নেবে। আর কারো না। একেবারে নাছোড়বান্দা। আমি এ-ও বলেছিলাম- আমি তো সাংবাদিক নই, রিপোর্টার। তার পরও তারা নিলেন না করিম ভাইয়ের অটোগ্রাফ। অগত্যা আমাকে অটোগ্রাফ দিতে হয়েছিল, অবশ্যই তা কেবল ইত্তেফাক সাংবাদিক বলেই। আজও স্মৃতিতে ভাসে শাহজাদপুর কুঠিবাড়ীর স্মৃতি। কুঠিবাড়ীর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে খুঁটির ওপর তখনও দাঁড়িয়ে ছিল পোস্ট অফিস ঘর। সেই চালা, বেড়া। পোস্ট অফিস ঘরের সামনে কুঠিবাড়ীর কাঠের সিঁড়িটি তখনও ছিল- যাতে রতন কবির কাছে আসত কিংবা নিচ থেকে ডাকত ‘বাবু ডেকেছো আমাকে?’ তারই পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইচ্ছামতি নদীতে মিশে যাওয়া খালটি। যাকে দেখে কবি লিখেছিলেন- * যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন এই ঘাটে * আমি বাইবনা মোর খেয়া তরী ঐ ঘাটে গো... কিংবা যেখান থেকে নৌকা ছেড়ে পোস্টমাস্টার অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন, চোখ ভরা জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রতনকে পেছনে ফেলে...। তবে আজ আর সেসব নেই। সরকার কুঠিবাড়ী সংরক্ষণ করেছে সত্য কিন্তু সেই ইছামতিতে এখন আর স্রোত বয়না। সেই খালটিও ভরাট হয়ে গেছে এবং ভূমিদস্যুরা তাতে দোকানপাট, নানান স্থাপনা তৈরি করে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। দৈনিক ইত্তেফাক প্রসঙ্গে যেন অনেক কথা বলে ফেললাম। তবে ইছামতির মতোই দৈনিক ইত্তেফাক আজ শীর্ণকায়। যাহোক, আমার এ্যাসাইনমেন্ট ছিল বাকশাল অফিসের সেমিনারটি কভার করার। আগেই বলেছি, মনিভাই বা শেখ ফজলুল হক মনি মূল আলোচক। তিনি প্রায় দেড়ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। তার বক্তৃতায় উঠে এলো তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সরকার কাঠামো ও তাদের শাসন। উঠে এলো দুই মহান বিপ্লবী-সোভিয়েতের ভ্লাদিমির লেনিন ও চীনের মাও সে তুং। বিশেষ করে লেনিনের বিপ্লব ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের শাসনের ওপর প্রায় একঘণ্টা বক্তৃতা করেন। রিপোর্টার হিসেবে আমার কাজ হলো, এ ধরনের সেমিনারের মূল বক্তব্যটি ছেঁকে তুলে রিপোর্ট আকারে নিজ পত্রিকায় পরিবেশন করা। কিন্তু মনিভাইয়ের বক্তৃতার কিছু অংশ বুঝতে পেরেছি, কিছু বুঝতে পারিনি। কি ছাঁকব বুঝতে পারছিলাম না। বক্তব্যের সারাংশও ঠিকমতো বের করতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে সেমিনার শেষ হয়ে গেল। সেদিন আমার সঙ্গে আরও দুজন রিপোর্টার কাভার করেছিলেন-একজন বার্তাসংস্থা ENA-র মতিউর রহমান (মরহুম) এবং অপরজন বার্তা সংস্থা বাসস-এর জাহাঙ্গীর হোসেন। মনিভাই সেমিনার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাদের সামনে দাঁড়ানো দেখে হাসলেন। বললেন- চলো প্রেসক্লাবে যাই, এককাপ চা খেয়ে তবে অফিস যাব। ড্রাইভারকে বললেন রিক্সা করে প্রেসক্লাবে চলে যেতে। তিনি ড্রাইভিং সিটে বসলেন এবং গাড়ি চালাতে চালাতে তার বক্তব্যের সারাংশ আমাদের বুঝিয়ে দিলেন। প্রেসক্লাবে এসে এককাপ চা খেয়ে চলে গেলেন। ঐদিন আর দাবা খেলার সময় ছিল না। কিন্তু রিপোর্টটি ছাপা হলো না, মনিভাইও দেখতে পেলেন না। মনিভাই চলে যাবার পর এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, সোশ্যালিস্ট রাষ্ট্র কাঠামোতে পার্টি হচ্ছে মূল শক্তি। গবর্নর একটি এলাকার প্রশাসনিক প্রধান। পার্টি সেক্রেটারি তার সংগঠন দিয়ে ওই এলাকার রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজ পরিচালনা করেন। জানতাম, মনিভাই লেখাপড়া জানতেন। কিন্তু তার জ্ঞানের গভীরতা যে এত বেশি ঐদিন বুঝতে পারলাম। এই মনিভাইয়েরও আইয়ুব-মোনায়েম প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রী কেড়ে নেয়া হয়েছিল। ষাটের দশকের প্রথমদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন (Convocation) অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। গ্র্যাজুয়েশন ও মাস্টার্স ডিগ্রীর সার্টিফিকেট দেয়া হবে। এবং সার্টিফিকেট নিতে হবে মিলিটারি একনায়ক মার্শাল আইয়ুব খানের এক নম্বর চামচা মোনায়েম খাঁর কাছ থেকে। এই লোক আইয়ুবের এতই পোষ্য ছিলেন যে, জনশ্রুতি আছে-আইয়ুব ইসলামাবাদ থেকে টেলিফোন করলেও দাঁড়িয়ে যেতেন এবং মাথায় টুপি পরে তবেই কথা বলতেন। মনিভাইরা কয়েকজন মোনায়েম খাঁর বিরোধিতা করলেন এবং খাঁ মঞ্চে এলে রীতিমতো ইট- পাটকেল দিয়ে ডেমোনেস্ট্রেশন দিলেন; যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনিভাইকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করলেন। সার্টিফিকেট কেড়ে নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ব্রিটিশের ভারত বিভাগ মেনে নিতে পারেননি। তাই তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’ বিভাগে ভর্তি হন। যথারীতি লেখাপড়া করেছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন চলছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের নেতৃত্ব দিতে যেয়ে বর্তমান সচিবালয়ের পাশে মিছিল থেকে গ্রেফতার হন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শর্ত দেয়-তিনি রাজনীতি করবেন না মুচলেকা দিলে এবং জরিমানা দিলে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু যার নাম বাংলার আপামর মানুষের কাছে শেখের বেটা- আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নোয়াবার নয়। তার সঙ্গে আরও দু’একজন ছিলেন (নাম মনে নেই), তারা মুচলেকা দিয়ে, জরিমানা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। কিন্তু বাঙালীর শেখের বেটা মুচলেকা-জরিমানা তো দূরের কথা জেলেই থাকলেন, ছাত্রত্ব গেল, তবু মাথা নোয়ালেন না। বঙ্গবন্ধুরই ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি। একটি প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর সাহস ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার পেয়ে গেলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকেও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ হত্যা করে কুলাঙ্গাররা। মনিভাই সম্পর্কে কিছু খন্ডস্মৃতি মনে পড়ছে। তিনি তখন দৈনিক বাংলার বাণী ও ইংরেজী দৈনিক Bangladesh Times-এর সম্পাদক। অফিসে যাবার পথে প্রেসক্লাবে কিছু সময় কাটিয়ে যেতেন। কাউকে পেলে এককাপ চা খেতে খেতে এক গেম দাবা খেলতেন কিংবা ফয়েজ ভাই, মুসা ভাই, মুকুল ভাইয়ের মতো কাউকে পেলে আরও কিছু সময় কাটিয়ে যেতেন। ১৯৭৩ সাল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ইতি টেনে দৈনিক ইত্তেফাকের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হতে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু তখনও মনের মধ্যে দ্বিধা সাংবাদিকতা করব নাকি সরকারী অন্য কোন জব নেব। এমনি ভাবতে ভাবতে মতিঝিলে বাংলার বাণী অফিসে যেয়ে মনিভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। মনিভাই কি বুঝলেন জানি না, বললেন- * কী ইত্তেফাক ভাল লাগছে না? * বললাম, ঠিক তা নয়, সাংবাদিকতা পেশায় থাকব কিনা তাই ভাবছি। * বললেন, সাংবাদিকতায়ই থেকে যা। ইত্তেফাক ভাল না লাগলে আমার এখানে চলে আসবি। বাংলার বাণী আছে, বাংলাদেশ টাইমস আছে, যে কোন একটায় জয়েন করতে পারবি। মনে পড়ল শিল্পী হাশেম খানের (চাচা) কথা। তিনিও বলেছিলেন, ইত্তেফাকে থাকতে এবং সাংবাদিকতা করতে। সে প্রায় ৪৬ বছর আগের কথা। মনিভাই আমাদের ছাত্রলীগের সবচেয়ে সাহসী ও মেধাবী নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিএলএফ (Bangladesh Liberation Front) বা মুজিব বাহিনী গঠন ও অন্যতম প্রধান লিডার ছিলেন। আজ বুঝতে পারছি, লিডার কখনও ভুল পথ দেখান না। সঠিক পথই দেখান। আমাকেও সঠিক পথই দেখিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুবলীগ গঠন করে যুবসমাজকে সঠিক পথ দেখান, যে পথ আজও খোলা। এখন বিজয়ের মাস। এই মাসের ৪ তারিখ মনিভাইয়ের ৮০ তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। ঢাকা- ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সংসদ সদস্য সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×