ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ ইটভাঁটি অবৈধ

প্রকাশিত: ১০:২০, ৩০ নভেম্বর ২০১৯

  উত্তরাঞ্চলের  অধিকাংশ  ইটভাঁটি  অবৈধ

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ উত্তরাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক ইটভাঁটি অবৈধ। বগুড়ায় অবস্থিত রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী ১৬ জেলায় ইটভাঁটির সংখ্যা ১ হাজার ৯শ’ ৮০। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেয়া আছে ১ হাজার ১শ’ দশটির। ২০১৬ সালে পরিবেশ সংরক্ষণে ইটভাঁটি স্থাপনে নতুন নীতিমালা জারি হয়। খোঁজখবর করে জানা যায়, এই আইন মেনে চলা হয় না। অনেক ইটভাঁটির কাছেই ঘনবসতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি ক্লিনিক হাসপাতাল আছে। কিছু ইটভাঁটি পৌর এলাকার মধ্যে হওয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎসের মধ্যে একটি ইটভাঁটির কালো ধোঁয়া। বগুড়া শহরের দক্ষিণে পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত এলাকা ও শাজাহানপুর উপজেলার কাছে কয়েকটি ইটভাঁটি আছে। যে কারণে বগুড়া পৌর এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। মহাসড়কের দুই ধারের গাছগাছালি ইটভাঁটির কাছাকাছি হওয়ায় সরাসরি কালো ধোঁয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক গাছ টিকছে না। পাতাগুলো অসময়ে ঝরে সবুজ থাকছে না। এদিকে ইট তৈরিতে নীতিমালা না মেনে মাটি ব্যবহার হচ্ছে। আইনে বলা আছে আবাদি জমি, খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর, মজা পুকুরের আশপাশে, বসতভিটা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশপাশ থেকে ইটভাঁটির মাটি কাটা চলবে না। আবাদি ভূমির টপ সয়েল (ওপরিভাগের মাটি) নেয়া চলবে না। বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের আশপাশে ইটভাঁটি স্থাপন করা যাবে না। মাঠ পর্যায়ে দেখা যায় বেশিরভাগ ইটভাঁটি কোন নিয়মনীতি মানছে না। এমনও ইটভাঁটি আছে যা রাস্তা সীমানার মাটি কেটে নিয়েছে। এই বিষয়ে ইটভাঁটি মালিক সমিতির সভাপতির কথা আইন মেনে ইটভাঁটি চালাতে গেলে ইটের মাটি পাওয়া যাবে না। সরকারীভাবে ইট তৈরিতে যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে তা স্থাপনে বহু কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এই প্রযুক্তিতে ইট উৎপাদনের পর তা বেশি দামে বিক্রি না করলে লোকসান গুনতে হবে। এই মন্তব্য ইটভাঁটি মালিকদের। তবে পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানাচ্ছে, পরিবেশ সংরক্ষণে ইটভাঁটিকে আধুনিকায়ন করে উন্নত ইট প্রস্তুত করে দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। দিনে দিনে ইটের চাহিদা বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলে এখন আর বাঁশের বেড়ায় খড় বা ছনের চালায় কুঁড়ে ঘর নির্মিত হয় না। জীবনমান উন্নত হওয়ায় বসতভিটা উন্নত হচ্ছে। একজন কৃষকের বাড়ি এখন টিনের চালায় ইটে নির্মিত। বগুড়া জেলা ইটভাঁটি মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জানালেন, গ্রামের অতি সাধারণ কৃষক এখন স্বল্প মূল্যের তিন নম্বর ইট কিনে বাড়ি নির্মাণ করে। এই মানের ইট প্রতি হাজার বিক্রি হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়। উন্নতমানের ইট বিক্রি হয় প্রতি হাজার ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায়। এর বাইরে সরকারী ও বেসরকারী, ব্যক্তি উদ্যোগ, রিয়েল এস্টেটসহ সকল অবকাঠামো নির্মাণে ইটের ব্যবহার হচ্ছে। সরকার উন্নতমানের ইট তৈরিতে বিদেশের হাইব্রিড হফসম্যান প্রযুক্তি ও টানেল প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো ইট তৈরিতে এক ধরনের অটোমেটিক যন্ত্র। মাটি এই যন্ত্রে দেয়ার পর ইটের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিতে হয়। এরপর মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাটি ছেনে ইট তৈরি করে ছোট ছোট ভ্যানে ইটভাঁটির ভেতরে পৌঁছে দেয়। এরপর পোড়ানো হয়। টানেল প্রযুক্তিও প্রায় একই ধরনের। এই প্রযুক্তি স্থাপনে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা প্রয়োজন। আর মাঝারি ইটভাঁটি নির্মাণে ব্যয় হয় মান ভেদে ৬০ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা। দেশে বর্তমানে তিন ধরনের ইটভাঁটি আছে। স্থায়ী চিমনি ভাঁটি, জিগজ্যাগ ভাঁটি ও হাইব্রিড হফসম্যান ভাঁটি। বগুড়ায় ইটভাঁটি ২শ’ ১১টি। এর মধ্যে জিগজ্যাগ ইটভাঁটি ১শ’ ৮টি, স্থায়ী চিমনি (১শ’২০ ফুট উচ্চতার চিমনি) ৯৭টি ও হাইব্রিড হফসম্যান পদ্ধতির ইটভাঁটি দুটি। এর মধ্যে একটি টানেল ভাঁটি। পাবনায় ইটভাঁটি ১শ’ ১৬টি, রাজশাহীতে ১শ’ ৯৪টি, জয়পুরহাটে ১শ’ ৪৭টি, সিরাজগঞ্জে ১শ’ আটটি, গাইবান্ধায় ১শ’ ১৩টি, নাটোরে ১শ’ ২৪টি, নওগাঁয় ১শ’ ৬৫টি, রংপুরে ২শ’ ৩০টি, দিনাজপুরে ২শ’ একটি, নীলফামারীতে ৪৪টি, লালমনিরহাটে ৪৪টি ও পঞ্চগড়ে ৪৩টি। একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো তা হলো, নিকট অতীতে উত্তরাঞ্চলের রংপুর জেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল বেশি। সেই জেলায় এখন ইটভাঁটির সংখ্যা উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মধ্যে বেশি। এত ইটভাঁটির মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১৯টি ভাঁটি পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড হফসম্যান ও টানেল প্রযুক্তির। নওগাঁয় ১৬৫ ইটভাঁটির মধ্যে নিষিদ্ধ ড্রাম পদ্ধতির স্থায়ী চিমনি দিয়ে চলে ৭৩টি। আধুনিক জিগজ্যাগ চিমনি আছে ৯২টি। এদিকে ২০১৬ সালের ১ জুলাই নতুন আইন কার্যকর করার আগে বলা হয়েছিল, যাদের ইটভাঁটি ১শ’ ২০ ফুট উঁচু চিমনি পদ্ধতির তাদের ইটভাঁটি জিগজ্যাগে রূপান্তর করে নিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যারা জিগজ্যাগ করবে না তাদের ২ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে জিগজ্যাগে রূপান্তর করে নিতে হবে। পরবর্তী সময়ে ইটভাঁটির কয়েকজন মালিক উচ্চ আদালতে রিট করে সাধারণ চিমনি ভাঁটিতে ইট পোড়ানো চালু রাখার আবেদন জানায়। বগুড়া আঞ্চলিক পরিবেশ অধিদফতর জানায়, উত্তরাঞ্চলে অনুমোদনহীন অনেক ইটভাঁটি আছে। এসব ইটভাঁটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমান চিত্র হলো, এখনও অনুমোদনহীন কোন ইটভাঁটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
×