ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারী চা-শ্রমিকের চালচিত্র

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৯ নভেম্বর ২০১৯

 নারী চা-শ্রমিকের চালচিত্র

সিলেট ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয় সিলেট অঞ্চলে চা চাষের মাধ্যমে। আজ থেকে ১৬৫ বছর পূর্বে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মালনিছড়ায় দেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের মাধ্যমে মূল্যবান এ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে যখন এ দেশে চা-বাগান স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় সে সময়ে চা চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণ শ্রমিকের প্রয়োজন আবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সে লক্ষ্যে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর তত্ত্বাবধানে অবিভক্ত ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর শ্রমিকদের আগমন ঘটে এ দেশে। এরপর ক্রমান্বয়ে দেশের চা শিল্প সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে চা শ্রমিকরা ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন এলাকায়। বাড়তে থাকে চা চাষ সম্প্রসারণ এলাকা, বাড়তে থাকে শ্রমিকদের সংখ্যাও। চা শিল্পের সঙ্গে নারী চা শ্রমিকদের সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। নারী শ্রমিকরাই চা গাছের ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ চয়ন করে থাকেন। চা শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধারণা চা গাছ থেকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি উত্তোলনে বা চা চয়নে পুরুষ শ্রমিকদের থেকে নারী শ্রমিকরা অধিক দক্ষ। চা গাছ থেকে কুঁড়ি উত্তোলনে নারী শ্রমিকদের হাতের আঙ্গুল পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। তাই তো নারী শ্রমিকরা চা শিল্পের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছেন। পুরুষ চা শ্রমিকরা চা বাগানের আগাছা পরিষ্কার করা, চায়ের চারা রোপণ, নার্সারিতে চারা উৎপন্ন করা, ছায়াবৃক্ষ বা ‘শেডট্রি’ রোপণ, বাগান পাহারা, ফ্যাক্টরিতে চা উৎপাদনে সহায়তা করাসহ বাগানের অনান্য কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশে মূল বাগান এবং ফাঁড়ি বাগান মিলিয়ে মোট ২৫১টি চা বাগানে মোট জনসংখ্যা প্রায় সাত লক্ষাধিক। ২৫১টি চা বাগানের মধ্যে ১৬৩টি মূল বাগান ও ৮৮টি ফাঁড়ি বাগান। যেসব চা বাগানে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি রয়েছে সেসব বাগানকে মূল বাগান এবং ফ্যাক্টরিবিহীন চা বাগানগুলোকে ফাঁড়ি বাগান হিসেবে অভিহিত করা হয়। চা বাগানের সাত লক্ষাধিক জনসংখ্যার মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক রয়েছে দেড় লক্ষাধিক। এর মধ্যে শুধু নারী শ্রমিক রয়েছে প্রায় অর্ধ-লাখ। অস্থায়ী ও স্থায়ী শ্রমিক মিলিয়ে চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত রয়েছেন কমপক্ষে আড়াই লক্ষাধিক। এর মধ্যে স্থায়ী ও অস্থায়ী নারী শ্রমিক রয়েছে লক্ষাধিক। এসব নারী শ্রমিকদের মধ্যে আবার রয়েছে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির শ্রমিক। তাদের দৈনিক হাজিরা (বেতন) ক্যাটাগরি ভিত্তিতে পরিশোধ হয়। ‘এ’ ক্যাটাগরির একজন শ্রমিক দৈনিক ১০২ টাকা হাজিরা প্রাপ্ত হন। সপ্তাহের রবিবার বাগানের কাজকর্ম বন্ধ থাকে। এ হিসেবে একজন চা শ্রমিকের সাপ্তাহিক হাজিরা মাত্র ৬১২ টাকা। মাস হিসেবে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৪৮ টাকা। এত অল্প বেতন নিয়ে চা শ্রমিকদের সংসার পালন অত্যন্ত কষ্টকর হলেও তারা নিজেদের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চা শিল্পের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অবদান রেখে চলেছেন। চা শিল্পাঞ্চলে নিয়োজিত নারী চা শ্রমিকরা প্রত্যহিক কাজে বের হন সকাল ৯টার মধ্যে। চা বাগানের শ্রমিক কলোনির জীর্ণ কুটির থেকে চা পাতা চয়নের উদ্দেশ্যে সকাল ৯টার আগে বের হয়ে চা বাগানের বিভিন্ন সেকশনে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চা পাতা চয়ন করে থাকেন তারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়, বৃষ্টি কোন কিছুই তাদের কাজের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। সব প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপক্ষো করে তারা প্রাত্যহিক কাজ করে থাকেন। প্রায় ৭ ঘণ্টা চা পাতা চয়নের মাঝে দুপুরে খাবারের জন্য আধা ঘণ্টা ছুটি দেয়া হয়। এ সময় চা বাগানের ছায়াদানকারী বৃক্ষের নিচে বসে সেরে নেয় দুপুরের নাস্তা বা হালকা খাবার। তাদের দুপুরের খাবারের তালিকায় অধিকাংশ সময়ে থাকে আটা দিয়ে তৈরি শুকনো রুটি। এছাড়া কচি চা-পাতা, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, লবণ দিয়ে তারা এক ধরনের ভর্তা জাতীয় খাবার তৈরি করে খেয়ে থাকেন। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চা সেকশনে চায়ের কচিপাতা উত্তোলন বা পাতা চয়নের পর চা-পাতাগুলোর মাপার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সেকশনের পাতিঘরে। চা পাতা মাপা শেষ হলে নারী চা শ্রমিকরা টিলা বাবুর কাছে হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। নারী চা শ্রমিকরা চা চয়নের সময় সাধারণত শুধু ব্লাউজ ও পেটিকোট পরিধান করে থাকেন। তবে অল্প বয়সী তরুণী-যুবতীরা সেলোয়ার, কামিজ পরেন। নারী চা শ্রমিকদের কথা বলতে গিয়ে ফিনলে টি কোম্পানির বুড়বুড়িয়া চা বাগানের নারী শ্রমিক শ্রীমতি হাজরা বলেন, ‘পুরুষ চা শ্রমিকদের তুলনায় নারী চা শ্রমিকরা চারগুণ বেশি পরিশ্রম করেন। কিন্তু তাদের হাজিরা (বেতন) পুরুষ চা শ্রমিকদের সমান। কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষদের থেকে কম হাজিরাও পেয়ে থাকেন। চা বাগানের সবচেয়ে কষ্টকর কাজ কচি চা পাতা চয়ন। আর এ কাজটি করে থাকে নারী চা শ্রমিকরাই। চা শিল্পের উন্নয়নে নারী চা শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি হলেও তাদের পরিশ্রমের মূল্যায়ন হয় না বললেই চলে।’ বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাব অনুয়াযী বাংলাদেশের চা শিল্পে প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজারের অধিক স্থায়ী চা শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার হচ্ছেন নারী চা শ্রমিক।
×