ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জামালপুরে বাড়ছে বিরল হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

জামালপুরে বাড়ছে বিরল হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা

নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর ॥ জামালপুরে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বিরল রক্তরোগ হিমোফিলিয়া রোগীর সংখ্যা। এ পর্যন্ত জেলায় হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত ১০ জনকে শনাক্ত করা গেছে বলে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত করেছেন। এ রোগের প্রয়োজনীয় ওষুধের দুষ্প্রাপ্যতা ও উচ্চমূল্যের হওয়ায় এ রোগে আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতে পারছেনা। রোগীরা সরকারি হাসপাতাগুলোতে এ রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করানোর দাবি জানিয়েছেন। চিকিৎসকরা জানান, হিমোফিলিয়া একটি বিরল রক্তরোগ। এ রোগে আক্রান্তদের শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। কোনো কারণ ছাড়াই যেকোনো সময় আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্ক, ঘাড়, গলা ও হাড়ের সংযোগস্থলে ফুলে যাওয়া বা রক্তক্ষরণ হতে পারে। আর তখনই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে ফ্যাক্টর এইট, ফ্যাক্টর নাইন ইনজেকশন ও ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা (এফএফপি ব্লাড) দিতে হয়। কিন্তু চিকিৎসার এই উপকরণগুলো সরকারি জেলা হাসপাতালগুলোতে না থাকায় রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে পাঠানো হয়। সূত্রটি জানায়, প্রতিটি ফ্যাক্টর এইট বা নাইন ইনজেকশনের মূল্য দুই হাজার ৭০০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। কখনো কখনো এর চেয়েও চড়া মূল্যে ক্রয় করতে হয় এই দুষ্প্রাপ্য ইনজেকশনগুলো। এ ইনজেকশনের অভাবে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা তাদের পরিবারের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সময়মতো এই ইনজেকশন দিতে না পারলে রোগীকে পঙ্গুত্ববরণ আ অকালে মৃত্যুও হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ইনজেকশন বিনামূল্যে সরবরাহ করা হলেও বাংলাদেশে এটি দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল। তবে দুরারোগ্য এই রক্তরোগে আক্রান্ত রোগীদেরকে প্রায় দুই যুগ ধরে বিনামূল্যে জীবন রক্ষাকারী ফ্যাক্টর এইট বা ফ্যাক্টর নাইন ইনজেকশন প্রদান করে আসছেন বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি নামের একটি সেবাদানকারী সংস্থা। ১৯৯৪ সালের ১৮ মার্চ রোগীদের কল্যাণে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ঢাকার গ্রিন রোডে ছোট্ট একটি অফিস ভাড়া নিয়ে হিমোফিলিয়া সোসাইটি তাদের সেবামূলক এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। জামালপুর পৌরসভার লাঙ্গলজোড়া গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে শাহরিয়ার হাসান উল্লাস (১৫) এই বিরল রক্তরোগে অক্রান্ত। তার বাবা শফিকুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের ৩ জুলাই খেলতে গিয়ে উল্লাসের ডান হাতের কব্জি কেটে যায়। তাৎক্ষণিক তাকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একদিন পরেও তার রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় তাকে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও তার অবস্থার উন্নতি না হলে তাকে পর্যায়ক্রমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, সোহরোওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও নিটোর হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু কোথাও রোগীর চিকিৎসা না হওয়ায় পরে বাধ্য হয়েই বেসরকারি একটি হাসপাতালে তার ব্যয়বহুল চিকিৎসা করানো হয়। উল্লাসের দরিদ্র বাবা অনেক কষ্টে ধারদেনা করে ওই সময় ছেলের চিকিৎসার জন্য প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয় করেন। এ সময় শাহরিয়ার হাসান উল্লাসের চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি। সংগঠনটি তার চিকিৎসাকালে তাকে বিনামূল্যে জীবন রক্ষকারী ফ্যাক্টর এইট ইনজেকশন দিয়ে সহায়তা করে। শাহরিয়ার ছাড়াও ইতিমধ্যে জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলায় সিয়াম, বিল্লাল, আবিদ, ইয়াছিন, ইয়ামিন, মতিউর, দিদার ও ইসলামপুর উপজেলায় হযরত ও জামালপুর সদরের মনজু নামের একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত করেছে। সরিষাবাড়ীতে এ রোগে আক্রান্ত ছয়জন রোগীর মৃত্যুও হয়েছে বলে জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা। আক্রান্ত রোগী ও স্বজনরা হিমোফিলিয়াকে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে এর চিকিৎসা নিশ্চিত করার আকুতি জানিয়েছেন। সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়নের কাবারিয়াবাড়ি গ্রামের হিমোফিলিয়া রোগী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমি একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাই ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করানো সম্ভব না হওয়ায় আমি এখন মৃত্যু পথযাত্রী।’ তিনি আরো জানান, অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় এই ঘাতক রোগে আক্রান্ত হয়ে শাহীন (৩০) ও স্বপন (১৪) নামের তার দুই ভাগ্নেরও অকাল মৃত্যু হয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত সরিষাবাড়ী উপজেলার মতিউর বলেন, ‘আমার তিন সহোদর মোহাম্মদ আলী(৩৫), আহম্মদ আলী (২৪) ও তোফাজ্জল হোসেনসহ (২০) এলাকার রাসেল (২৬) নামের আরো এক যুবকের হিমোফিলিয়া রোগে মৃত্যু হয়েছে। এ ব্যাপারে জামালপুরের সিভিল সার্জন গৌতম রায় জনকণ্ঠকে বলেন, এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের জরুরি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ফ্যাক্টর এইট, ফ্যাক্টর নাইন ইনজেকশন ও ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে পাওয়া যায় না। তাই এ ধরনের রোগীর দেহে রক্ত দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। এ ধরনের রোগীরা অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি সুচিকিৎসার ব্যাপারে সঠিক দিক নির্দেশনা দিবেন বলে জানান।
×