ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চার তরুণের এগিয়ে চলা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

চার তরুণের এগিয়ে চলা

হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে চলতে সৌখিনতার বশে ছবি তোলাই আজ রূপ নিয়েছে পেশাদারিত্বে। ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনচেতা মনোভাব আর প্রচ- পরিশ্রমের ফসল আজ তারা তুলেছেন ঘরে। আজ তাদের স্বপ্নের ড্রিম উইভার শুধু দেশে নয় বরং বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছে। গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে তাদের আট বছরে পদার্পণ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে তাদের বক্তব্যের মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই দেশপ্রেম এবং তাদের সফলতা একদিকে তরুণ প্রজন্মকে যেমন কর্মে উৎসাহিত করবে, অন্যদিকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করবে। তরুণ এই চার ফটোগ্রাফার দেখিয়ে দিয়েছেন ভাল লাগার বিষয়টিকেই পেশাদারিত্বে নিয়ে গেলে সফলতা অবিশ্যম্ভাবী। নইলে ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাস করা মানুষগুলো ফটোগ্রাফিতে এত ভাল হয় কী করে। যেভাবে যাত্রা শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ শেষে বন্ধুরা সবাই মিলে ঘুরতে গিয়েছিলেন কক্সবাজার। ইনানী বিচে বন্ধুরা সবাই একসঙ্গে লাফ দেবেন, সেই মুহূর্তটার ছবি তুলতে হবে। ক্যামেরা বলতে ছিল তৎকালীন সনি সাইবার শট ডিজিটাল ক্যামেরা। বন্ধুরা সবাই লাফও দেন, একজনের পর একজন চেষ্টাও করলেন কিন্তু মনমতো সেই ছবি আর ওঠে না। একটা ছেলেই শুধু সেই অসাধ্য কাজটা করতে পারল। সেই ছবি ঠাঁই পেল প্রত্যেক বন্ধুর ফেসবুক কভারে। সঙ্গে ফটো কার্টেসি – যোবায়ের হোসেন শুভ। সেই থেকে ফটোগ্রাফার শুভর নাম ডাক। যোবায়ের হোসেন শুভ, ড্রিম উইভারের প্রধান মুখ। ফটোগ্রাফি জগতে তার যাত্রাটা অনেক দিনের, অনেক বাঁধা পেরিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই মূলত ছবি তোলার পূর্ণ সত্তা প্রকাশিত হলেও তার পথচলাটা শুরু হয়েছিল সেই ছোট্টবেলায় কুমিল্লায় থাকা কালে। সে সময় তার বাবা শখ করে কিনে দিয়েছিলেন অটো রোলের ইয়াসিকা ক্যামেরা। তা দিয়েই ছোট্ট শুভ ঘুরে বেড়িয়েছেন কুমিল্লার রাস্তায় রাস্তায়, ছবি তুলে বেড়িয়েছেন সেই অটো রোলের ক্যামেরা দিয়েই। ২০১১ সালে বন্ধুদের দেখাদেখি ঝোঁক বাড়ে ডিএসএলআর এর প্রতি। কিন্তু বাসায় বললে কখনোই কিনে দেবে না। অগত্যা নিজের টিউশনি করে এবং গেমিং প্রোডাক্ট সেল করে জমানো টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন শখের ডিএসএলআর, ডি৭০০০। সঙ্গে ছিল ১৮-১০৫ লেন্স, ৩৫মিলিমিটার লেন্স এবং একটি ফ্ল্যাশ। শুধু ক্যামেরা কিনেই ক্ষান্ত ছিলেন না শুভ। প্রতিনিয়ত গুগল করে এবং ইউটিউব দেখে শিখেছেন সেই ক্যামেরার নিত্য নতুন ফাংশন এবং বিভিন্ন কাজ। ছবিও তোলা হতো ক্যাম্পাসে এবং ক্যাম্পাসের বাইরে। বনানী ওভারব্রিজ থেকে তোলা একটি ছবি জায়গা করে নেয় ২০১১ এর আন্তর্জাতিকমানের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় এক্সিবিশন ‘ব্রেক দ্য সার্কেল’-এ। ২০১২ এর এক্সিবিশনেও জায়গা পায় শুভর তোলা ছবি। যখন শেষ বর্ষে তখন শুভর ইচ্ছা হলো ব্যাচের সব বন্ধুর বিভিন্ন পোজে একক ছবি তুলে একটা এ্যালবাম করবেন। নিজের ক্রিয়েটেভিটি দিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে তোলা সেই ছবিগুলো দেখেই সবাই বুঝে গেল – এই ছেলেটা আলাদা। তার মধ্যে ফটোগ্রাফির আলাদা একটা প্রতিভা আছে। সেখান থেকেই বন্ধু তাঞ্জিবের বোনের বিয়েতে ছবি তোলার জন্য অফার পান শুভ। পরিচিত সিনিয়র, বড় ভাই থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও একে একে সবাই তাদের বিভিন্ন কাজের ছবি তোলার জন্য খুঁজতে থাকেন এই শুভকে। বিয়ের ছবি তুলতে গেলে একা সম্পূর্ণটা কভার করা কঠিন হয়ে যায়। তাই সঙ্গে নিয়ে যেতেন অন্য কাউকে। কখনও বন্ধু, কখনও বা জুনিয়র। সেখান থেকেই আলাদা করে নজর কাড়েন রাফি, নাফিস এবং ইমরান। আর তারপর সবাইকে নিয়ে শুরু করেন নিজের কোম্পানি – ড্রিম উইভার। এরপর থেকেই টুকটাক যোবায়ের শুভর সঙ্গে বাকি তিনজনের ওঠাবসা, ছবি তুলতে যাওয়া। এভাবে চলতে চলতেই চারজন মিলে মার্র্চের এক রাতে বসে চিন্তা করে ফেলেন, নিজেরা মিলে একটা ফটোগ্রাফি গ্রুপ করে ফেললে কেমন হয়? ভাবনাটা আসে সেখান থেকেই। ছবি তোলার প্রতি আগ্রহটা কারোরই তো কম নয়। এই আগ্রহটাকে কাজে লাগিয়ে পেশায় রূপান্তর করা যায় যদি! যোবায়ের শুভও চিন্তা করলেন, অনেককে নিয়েই ছবি তুললাম, তবে এই তিন জুনিয়র তাদের মধ্যে সব থেকে ভাল কাজ করল, আগ্রহ দেখাল। তিনিও সায় দিলেন নির্দ্বিধায়। মার্চের ওই রাত থেকেই শুরু হয়ে গেল ড্রিম উইভারের পথচলা। যোবায়ের শুভ প্রধান চালক, সঙ্গে থাকবেন নাফিস, ইমরান এবং রাফি। তার দু’দিন বাদেই শুভর কাছে ফোন এলো – ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই এবং তৎকালীন আইইউটির লেকচারার রেজওয়ান সাহেবের। তার বিয়ের প্রোগ্রাম পাবনাতে। মার্চের ২৯ তারিখে। আনুষ্ঠানিকভাবে ড্রিম উইভারের প্রথম শূট। যখন শূট করতে যাবেন তার আগে সবার মাথায় কাজ করল, আচ্ছা গ্রুপ না হয় হলো, কিন্তু গিয়ে পরিচয়টা কী দেব! একটা নাম তো ঠিক করা লাগে। সঙ্গে নিজেদের একটা ভিজিটিং কার্ড যদি নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে কিছুটা প্রচারণাও করা যেত। সফটওয়্যারে টুকটাক কাজ পারার দরুন দায়িত্ব পড়ল নাফিসের ঘাড়ে। লোগো বানিয়ে ভিজিটিং কার্ড বানাতে হবে। মুসিবত হলো – নামটা তো আগে ঠিক করতে হবে, তারপর না হয় লোগো আর ভিজিটিং কার্ড। একেকজন একেক নাম প্রস্তাব করলেও সবার কেন জানি পছন্দ হচ্ছিল না। কী দেয়া যায় সেই নাম? ইভেন্ট মার্চের ২৯ তারিখে। অথচ ঠিক তার দুদিন আগেও নাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আইনস্টাইনের বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। যাবতীয় আবিষ্কার নাকি তিনি বাথরুমে বসে চিন্তা করার সময় তার মাথায় আসত। শেষাবধি নাফিস আবির্ভূত হলেন সেই আইনস্টাইন হিসেবে। বাথরুমে বসে চিন্তা করতে করতেই তার মাথায় আসে একটা ওয়েব ডিজাইনিং সফটওয়্যারের নাম ‘ড্রিম উইভার’! বাহ্ সুন্দর তো। সবাই তাদের বিয়ের মুহূর্তগুলোর জন্য আজন্ম স্বপ্ন বুনে থাকে। আর সেই বিশেষ মুহূর্তগুলোতে স্বপ্ন বুনতে থাকে আর একটা মানুষের সঙ্গে আজীবন একসঙ্গে থাকার। তা হলে তাদের সেই স্বপ্ন বুনে রাখার স্মৃতিগুলোই আমরা ধরে রাখি! কনসেপ্ট দারুণ। একবাক্যে পছন্দ হয়ে গেল বাকি সবার। শুরু হয়ে গেল চার তরুণের স্বপ্নের বাস্তবায়ন – ড্রিম উইভার ড্রিম উইভার ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে।
×