ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য

হৈমন্তিক আনন্দ-হাইত উৎসব, বুড়ির বাঁধে মাছ ধরা

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২৪ অক্টোবর ২০১৯

হৈমন্তিক আনন্দ-হাইত উৎসব, বুড়ির বাঁধে মাছ ধরা

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ আগাম ঘোষণা দিয়ে বছরের নির্ধারিত দিনে মাছ ধরাকে স্থানীয়ভাবে ময়মনসিংহে ‘হাইত উৎসব’ বলা হয়। এজন্য এলাকার হাট ও বাজারে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আগাম ঘোষণা দেয়া হয়। মাছ ধরার এমন উৎসবে ছেলে-বুড়ো সবাই যোগ দেয়। তবে এজন্য কাউকে কোন টাকা-পয়সা দিতে হয় না। উৎসব চলার সময় একটু পরপর সমস্বরে চিৎকার ‘হই হই... হই হই...।’ এ দৃশ্য দেখে বিল পাড়ের মানুষও উল্লাসে ফেটে পড়ে। গত ১৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার উপজেলার চ-ীপাশা ইউনিয়নের জলা, কলম্বো ও দিঘা বিলে কয়েক হাজার মানুষ ‘হাইত উৎসবে’ মেতে উঠেছিল। অনুরূপভাবে ঠাকুরগাঁও জেলার বুড়ির বাঁধ এলাকায় প্রতিবছরের ন্যায় এবারও অনুষ্ঠিত হয় মাছ ধরার উৎসব। এতে শামিল হয় নানান বয়সী মানুষ। জানা গেছে, অনেক বছর আগে থেকেই খাল-বিল, জলাশয়ে ভরা ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় হেমন্তকালে ‘হাইত’ উৎসব হয়ে আসছে। সেই ঐতিহ্য অনুসরণ করে এবারও চ-ীপাশা ইউনিয়নের জলা, কলম্বো ও দিঘা বিলে হাইতের আয়োজন করা হয়। সাধারণত বছরের এ সময় খাল-বিলের পানি কমে হাঁটুসমান হয়ে এলে হাইতের আয়োজন করেন বিলপারের মানুষজন। তারা একত্রে বসে একটি তারিখ ঠিক করে দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দেন। সেই সঙ্গে এলাকায় মাইকিং ও ঢোল পিটিনো হয়। ‘দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এই উৎসব উপলক্ষে আগের দিন চলে আসেন। তারা নিজ বাড়ি থেকে পিঠাপুলি নিয়ে আসেন। পরে সারা রাত ধরে বিলের পাড়ে সবাই মিলে সেগুলো খেয়ে রাত পার করে দেয়। ভোরের আলো ফুটলেই আশাপাশের ২০/২৫ গ্রামের হাজার হাজার মানুুষ একত্রিত হয়ে জাল, পলো, ইত্যাদি নিয়ে বিলে মাছ ধরতে নেমে পড়েন। ভাগ্য ভাল হলে কেউ বড়সড়ো মাছ পান। আবার কেউ ফেরেন খালি হাতে। মাছ না পেলেও আনন্দের কমতি হয় না।’ বিল পাড়ের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, হাইতকে সামনে রেখে তার বাড়িতে মেয়ের জামাইসহ অন্য আত্মীয়স্বজনরা এসেছে। বিলের উৎসব যেন তার বাড়িতেও পড়েছে। কাশেমের সঙ্গে মেয়ের জামাইও মাছ ধরতে নেমেছেন। পালাহার গ্রামের হারুন মিয়া ২৫ বছর ধরে হাইত উৎসবে আসেন। তিনি বলেন, ‘পলো বাওয়া অইলো শখ, হগল দিন মাছ পাওয়া যায় না। অনেক দূর থাইক্যা আসি আমরা। কিছু কিছু দিন এমুনও হয় ১০০ টাকার বেশি খরচ লাইগ্যা যায়। তার পরও আনন্দ লাগে।’ ১৮ কিলোমিটার দূরের রাজগাতী ইউনিয়নের কালিগঞ্জ এলাকা থেকে পলো নিয়ে মোটরবাইকযোগে তিনজন এসেছেন হাইত উৎসবে। তারা জানায়, প্রতিবছর এই বিলে মাছ ধরতে আসেন। তাদের মধ্যে একজন মাছ পেলেও বাকি দুই জনকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। অন্য বছর এই বিলে ভালো মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বিলের চারপাশে ফিসারি তৈরি করায় মাছের সংখ্যা কমে গেছে। মাছ পেলেও তাদের আনন্দের কমতি ছিল না বলে জানায়। হাইত উৎসব দেখতে বিলের পাড়ে দাঁড়ানো অবস্থায় খামার গাঁও গ্রামের মজুমদার প্রবাল বলেন, এখন বিলগুলোতে আর আগের মতো মাছ নেই। তবু হাইত আয়োজনের খবর পেলে দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ মাছ ধরতে বিলে আসে। ছেলে-বুড়ো রাত জেগে বসে থাকে ভোর হওয়ার আশায়। আলো ফুটলেই একসঙ্গে সবাই বিলে নেমে পড়ে মাছ ধরতে। তারপর যত না মাছ ধরা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় আনন্দ-উল্লাস। নান্দাইল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরিফ আহম্মেদ বলেন, ‘বিলে হাইত উৎসব গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখা উচিত। তবে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে কিছু জলাশয়কে উন্মুক্ত রাখতে হবে। ঠাকুরগাঁও জেলার বুড়ির বাঁধের দৃশ্য। কারও হাতে পলো, কারও হাতে চাবিজাল, খেয়াজাল, টানাজাল বা ছেঁকাজাল। কেউবা ছোট নৌকায়, কেউবা কলা গাছের ভেলায় চড়ে ছুড়ে দিয়েছেন জাল। যাদের মাছ ধরার সরঞ্জাম ছিলনা তারাও বসে ছিলেন না। খালি হাত দিয়েই তারাও ব্যস্ত ছিলেন কাদার মাঝে মাছ খোঁজার কাজে। আর এসব দৃশ্য দেখে আনন্দে মাতোয়ারা হচ্ছিলেন নদীর তীরে ভিড় জমানো নানান বয়সের হাজার হাজার মানুষ। তাদের অনেকেই আবার মাঝে মাঝে একসঙ্গে চিৎকার দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেলেন নদীতে যারা মাছ ধরছিলেন তাদের। গত ১৯ অক্টোবর শনিবার ভোররাত থেকে দিনব্যাপী এমনই আনন্দঘন পরিবেশে মাছ ধরার উৎসব/মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ও চিলারং ইউনিয়নের শুক নদীতে নির্মিত বুড়ির বাঁধ এলাকায়। প্রতিবছরের মতো এবারও ভোররাতে বাঁধের গেট খুল দেয়ায় মাছ ধরার এ উৎসবে যোগদেন শুধু আশপাশের গ্রামের নয়, জেলার বিভিন্ন এলাকার এমনকি পার্শ্ববর্তী জেলার হাজার হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে মাছ ধরতে দিনব্যাপী ব্যস্ত ছিলেন, নানান বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশু এবং বাদ যাননি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগণও। তাদের পাশাপাশি পেশাদার জেলেরাও মাছ শিকার করে বাঁধ এলাকাতেই বসেছিলেন টাটকা মাছ বিক্রির পসরা সাজিয়ে। অনেকে সেখানে গিয়েছিলেন অল্প দামে সেই মাছ কেনার আশায়। শুধু মাছের দোকান নয় সেখানে বসেছিল নানান স্বাদের নানান খাবারের দোকান। তাদের সবার ভিড়ে ও ব্যস্ততায় পুরো এলাকা উৎসবে পরিণত হয়। মানুষের ভিড়ের সুযোগ নিয়ে অনেক বিক্রেতা মাছের দাম হাঁকিয়েছেন ইচ্ছেমতো। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে ১৯৫১ সালে সেখানে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে ১৯৫৭ সালে দিকে শেষ হলেও বাঁধটি কোন কাজে আসেনি। পরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালের দিকে এলাকার জমিতে সেচ সুবিধার লক্ষ্যে একটি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। দুটি ক্যানেলের মাধ্যমে কৃষকের ২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া হয়। বর্ষা মৌসুমে এই জলকপাটের উজানে ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ধরে রাখা পানিতে অভয়াশ্রম বানিয়ে প্রতিবছর জেলা মৎস্য অধিদফতর বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা অবমুক্ত করে থাকেন। আর এ পোনাগুলো যাতে কেউ শিকার করতে না পারে তা দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ। এরপর থেকেই প্রতিবছর শীতের শুরুতে পানির প্রয়োজন শেষ হলে বাঁধের জলকপাট খুলে দিয়ে এসব মাছ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এভাবেই বছরের পর বছর বুড়ির বাঁধ এলাকায় মাছ ধরার উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মাছ ধরতে আসা সোহেল রানা জানান, রাতেই এখানে এসেছি। শুনেছিলাম এখানে মাছ মারা হয়। প্রতিবার নাকি এই উৎসবটা হয়। তাই এবারও এসেছি। পুঁটি মাছ, দেশীয় গুঁড়া মাছ, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রকারের মাছ জালে আটকা পড়েছে। আমার মতো আরো অনেকে রাতেই এসেছেন এখানে। তথ্য সূত্র : সংবাদদাতা, নান্দাইল, ময়মনসিংহ এবং নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও।
×