ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিখোঁজ বাবার অপেক্ষায় ৮ বছরের আরওয়া

প্রকাশিত: ১০:২১, ৩১ আগস্ট ২০১৯

  নিখোঁজ বাবার  অপেক্ষায় ৮ বছরের  আরওয়া

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সাজেদুল ইসলাম সুমন যখন নিখোঁজ হন তখন মেয়ে আরওয়ার বয়স মাত্র দুই বছর। বর্তমানে আরওয়ার বয়স ৮। ছয় বছরেও বাবার দেখা পায়নি। গুমের সময় মনে দাগ না কাটলেও এখন প্রতিনিয়ত বাবাকেই খুঁজে ফেরে মেয়ে। ২০১৩ সালে ঢাকার নাখালপাড়া থেকে নিখোঁজ হন সুমন। তার বৃদ্ধ মায়ের অপেক্ষা যেন ফুরায় না। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মা এখন শয্যাশায়ী। শুধু সুমনের পরিবার নয় আরও অসংখ্য পরিবারের আর্তনাদ, আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তন। গত ৬ বছরে গুম হওয়াদের মধ্যে অন্তত ৪০ পরিবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে আলোচনাসভায় উপস্থিত হন। গুম হওয়া পরিবারদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এ আলোচনাসভার আয়োজন করে। সেখানে কথা হয় গুম হওয়া পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে। কারও শিশুসন্তান, কারও বৃদ্ধ বাবা-মা উপস্থিত হন। এসেছেন বোন-ভাইসহ স্বজনরাও। সবার হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি। দাবি একটাই, গুম হওয়াদের ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি গুমের মতো চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন বন্ধ করা। স্বামী বেঁচে আছে নাকি মরে গেছেন, তা তারা জানেন না। বাবা জীবিত নাকি মৃত অনেক শিশুসন্তানই তা জানে না। একদিন ফিরবে এমন সান্ত¡নাও ফিকে হয়ে আসছে দিন দিন। গুম হওয়া সুমনের বড় বোন আফরোজা ইসলাম ও মারুফা ইসলাম বলেন, আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, প্রায় ৫ বছর আট মাস পেরিয়ে গেলেও ভাইকে ফিরে পেলাম না। ওর (সুমনের) সন্তানের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। নিষ্পাপ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিআইডি, মানবাধিকার কমিশন, পুলিশ, র‌্যাবসহ এমন কোন জায়গা নেই যে আমরা দারস্থ হইনি। কিন্তু কেউ আমাদের সুমনের সন্ধান দিতে পারেনি। বিএনপি নেতা সুমনের মতোই কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সবুজ ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার গাজীপুর থেকে নিখোঁজ হন। সবুজের মেয়ে সুমাইয়া ফেরদৌসও (১০) বুঝেছে বাবার মতো অভিভাবক শূন্যতার যন্ত্রণা। গুম হওয়া সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আমি, আমার শাশুড়ি, মুক্তিযোদ্ধা বাবা, দুই সন্তানসহ সবাই অপেক্ষায় আছি, সবুজ একদিন ফিরে আসবে। প্রতিটা মুহূর্ত আমরা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। এ যন্ত্রণা সইবার নয়। স্বজন হারানোর ব্যথা মাত্র তারাই বুঝে যারা হারিয়েছে। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর পল্লবী থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তৎকালীন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজা পিন্টুকে (৩১) ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে আর খোঁজ মেলেনি। ছোট ভাই হাসনাইন বলেন, ভাইকে ফিরে পেতে কত জায়গায় গিয়েছি। কিন্তু ভাইকে পাইনি। এখন ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ, ভাইকে ফিরিয়ে দিন। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৩২ জন গুম হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫৮ জনের সন্ধান এখনও মেলেনি। গুম হওয়ার পর অনেককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার দেখালেও কারও কারও লাশ উদ্ধার হয়েছে। ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর পরের বছর থেকে ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। আলোচনাসভায় গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিবছর এই আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে আমরা মায়ের ডাকের আহ্বানে উপস্থিত হই। প্রতিবছরই আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই। যারা গুম হয়েছেন তারা যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসে। এখনও আমরা আমাদের হারিয়ে গুম হওয়াদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। তারা প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি মানবতার মা। আমাদের সন্তানরা গুম হওয়ায়, ফিরে না আসায় আপনার হৃদয়ে কি রক্তক্ষরণ হয় না। প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছেই অনুরোধ, আপনার একটি সিদ্ধান্তই একটি অসহায় মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। শিশুরা ফিরে পাবে তার বাবাকে। গত ৬ বছরে গুম হওয়া অনেকেই এখনও ফিরে না আসায় শোকে পরিবারের অনেকে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। গুম হওয়া মুন্নার বাবা প্রতিবছরই এ দিবসে উপস্থিত হলেও আজ তিনি আসেননি। কারণ, তিনি মারা গেছেন। বৃদ্ধ মা মরিয়ম বেগম এখন প্রায় অন্ধ। পারভেজ হোসেনের বাবাও সন্তানকে ফিরে না পাওয়ার শোকে মারা গেছেন। ছোট্ট হৃদি এখনও বাবার অপেক্ষায়। গুম হওয়া ছেলে সাইফুর রহমান সজিবের মা রেনু রহমানও না-ফেরার দেশে। বাবা শফিকুর রহমান নির্বাক চোখ অদূরে শুধু তাকিয়ে থাকেন। নিখোঁজ ঝন্টু, হুমায়ুন কবির, শাওন কিংবা তপুদের বাবাও না-ফেরার দেশে। তাদের মা’রাও অসুস্থ, কেউ চোখে ঝাপসা দেখেন। অথচ তারা জানেন না সন্তানদের অপরাধ কী। কে বা কারা গুম করেছেন আদরের সন্তানকে। গুম হওয়াদের মধ্যে অনেকে ফিরে এলেও অধিকাংশের খোঁজ মেলেনি। ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসের’ আলোচনা অনুষ্ঠানের নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুলসহ বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রতিবছর আমরা এই আলোচনা অনুষ্ঠানে আসি এবং একই রকম হতাশাগ্রস্ত মুখগুলো দেখি। কিন্তু ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের আহ্বান ক্ষমতাসীনদের কানে পৌঁছায় না। গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য আমরা স্বাধীন কমিশন গঠন ও ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাই, বলেন তিনি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, আপনি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছেন। জাতির প্রতি সবচেয়ে ভাল উপহার হবে, যারা গুম হয়েছেন তাদের সবাইকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া।
×